ভারতে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা ধরনের অপতথ্য, গুজব ও বিভ্রান্তিমূলক শত শত বিজ্ঞাপনকে অনুমোদন দিচ্ছে ইউটিউব। সম্প্রতি এমন এক অভিযোগ তুলেছে গ্লোবাল উইটনেস ও অ্যাকসেস নাউ নামের দুটি মানবাধিকার সংস্থা।
এমন এক সময় অভিযোগটি উঠল, যখন ভারতের জাতীয় নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। আগামী ১৯ এপ্রিল থেকে ১ জুনের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক এই দেশে সাতটি ধাপে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এই নির্বাচনেই নির্ধারিত হবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তৃতীয় মেয়াদে ভারতের ক্ষমতায় বসতে পারবেন কি না।
চলতি বছরে বিশ্বের অন্তত ৬৫টি দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে ভারতের নির্বাচনটি সবচেয়ে বড়। এ ছাড়া আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটিও বৈশ্বিক কারণেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব নির্বাচনকে সামনে রেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ‘নির্বাচনী গুজব’ ছড়ানোর মাত্রা বেড়েছে।
গ্লোবাল উইটনেস ও অ্যাকসেস নাউ জানিয়েছে, তারা ইউটিউবে প্রচারিত নির্বাচনী গুজব সংক্রান্ত ৪৮টি বিজ্ঞাপন পর্যালোচনা করেছে। বিজ্ঞাপনগুলোতে হিন্দি, তেলেগু ও ইংরেজি ভাষার ব্যবহার রয়েছে। ২৪ ঘণ্টার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ইউটিউব এসব বিজ্ঞাপন শতভাগ অনুমোদন দিয়েছে।
এই পর্যালোচনা এটিই নির্দেশ করে যে, অর্থের বিনিময়ে প্রচারিত এসব বিভ্রান্তিমূলক বিজ্ঞাপন বন্ধে গুগলের মালিকানাধীন ইউটিউব পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক অ্যাকসেস নাউয়ের সিনিয়র পলিসি কাউন্সেল নম্রতা মহেশ্বরী বলেন, ‘সত্যি বলতে, আমরা এমন ঘৃণ্য ফলাফল আশা করিনি। আমরা ভেবেছিলাম, ইউটিউব অন্তত ইংরেজি ভাষার বিভ্রান্তিমূলক বিজ্ঞাপনগুলো ধরতে পারবে। কিন্তু তারা তা করেনি। এর অর্থ হচ্ছে, ভাষা কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে, তারা কোন দেশের ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করছে, সেটি। আমাদের পর্যালোচনার ফলাফল এটিই প্রমাণ করে যে, বিশ্বব্যাপী সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতি ইউটিউবের শ্রদ্ধার অভাব রয়েছে।’
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে গুগল। প্রতিষ্ঠানটি বিবৃতির মাধ্যমে জানিয়েছে, ‘ইউটিউবের বিজ্ঞাপন নীতিমালা সব দেশের জন্য প্রযোজ্য এবং ধারবাহিকভাবে নীতিমালাগুলো প্রয়োগ করা হয়। সুতরাং ভারতের নির্বাচনী গুজব বা ভুল তথ্যের প্রচারে ইউটিউব বাধা দেয়নি, এমন অভিযোগ সঠিক নয়। আমাদের নীতিমালার একাধিক স্তর অতিক্রম করার পরই বিজ্ঞাপনগুলো প্রচারিত হয়। আমরা মনে করি, তাদের গবেষণা পদ্ধতিতে ত্রুটি রয়েছে।’
ভারতে প্রায় ৪৫ কোটি মানুষ ইউটিউব ব্যবহার করে থাকে। হোয়াটসঅ্যাপের পর ইউটিউবই ভারতে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপের চেয়ে ইউটিউবেই নির্বাচনী বিজ্ঞাপন প্রচার করছে রাজনৈতিক দলগুলো। কারণ ইউটিউবে বয়স, লিঙ্গ, অবস্থান, আগ্রহ ইত্যাদি প্রকারভেদ অনুসারে বিজ্ঞাপন প্রচার করা যায়। অর্থাৎ খুব সহজেই ‘টার্গেট অডিয়েন্স’ নির্ধারণ করা যায়। এ সব কারণে ইউটিউবের আয়ও বেশি। গুগলের সাম্প্রতিকতম পাবলিক ফিনান্সিয়াল স্টেটমেন্ট থেকে জানা যায়, শুধু ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসেই ইউটিউব বিজ্ঞাপন থেকে ৯২০ কোটি ডলার আয় করেছে।
অ্যাক্সেস নাউ জানিয়েছে, তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ইউটিউবে প্রচারিত নির্বাচনী বিজ্ঞাপনে ভোটারদের ভোট দেওয়া থেকে বিরত রাখতে ভুল তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে, ভোট দেওয়ার জন্য আইডির প্রয়োজন নেই, নারীরা ভোট কেন্দ্রে না গিয়ে টেক্সট মেসেজের মাধ্যমেই ভোট দিতে পারবেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, ভারতে ভোট দেওয়ার জন্য একটি সনাক্তকরণ আইডির প্রয়োজন হয়। আর পোস্টাল ব্যালট ছাড়া কোনোভাবেই ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই।
অপর এক বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে, ভোট দেওয়ার ন্যূনতম বয়স ২১ বছরে উন্নীত করা হয়েছে। তার চেয়ে কম বয়সী কেউ ভোট দিতে পারবেন না। কিন্তু ভারতে ভোটার হওয়ার ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর।
একই রকম আরেক বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে, সংক্রামক রোগ বেড়ে যাওয়ার কারণে ২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রতিটি ভোটারের ই–ইমেইলে স্বয়ক্রিয়ভাবে ‘মেইল ইন ব্যালট’ পাঠানো হবে। আপনারা ঘরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন। অথচ সংক্রামক রোগ সংক্রান্ত এ ধরনের কোনো বিধিনিষেধ ভারতে নেই।
এ ছাড়া আরও কিছু বিজ্ঞাপনে দেখা গেছে, সহিংসতা উসকে দেয় এমন উপকরণ রয়েছে ওই সব বিজ্ঞাপনে। যেমন, একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে দেখিয়ে বলা হচ্ছে, তারা ঘুষের বিনিময়ে ভোট দেয়। আরেকটি বিজ্ঞাপনে কিছু নির্দিষ্ট জায়গা দেখিয়ে বলা হচ্ছে, এসব জায়গা নির্বাচনী জালিয়াতির হটস্পট। অপর এক বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে, ভোটকেন্দ্রে কারা যায়, তাদের আমরা দেখে নেব।
মার্কিন সাময়িকী টাইম জানিয়েছে, তারা প্রতিটি বিজ্ঞাপন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। তবে নিরাপত্তার খাতিরেই তারা সম্প্রদায়গুলোর নাম উল্লেখ করেনি।
অ্যাক্সেস নাউয়ের গবেষণা প্রতিবেদনের লেখকেরা বলেছেন, ‘আমরা গবেষণার ফলাফল দেখে বুঝতে পারছি, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ক্রমশ বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলো গুজব, বিভ্রান্তি ও উসকানি ছড়ানো রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।’
এর আগে ২০২২ সালে গ্লোবাল উইটনেস অ্যান্ড অ্যাক্সেস নাউ ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষার নির্বাচনী বিজ্ঞাপনগুলো একইভাবে পর্যালোচনা করেছিল। সেই ফলাফলে অ্যাক্সেস নাউ দেখতে পেয়েছিল, বিভ্রান্তিমূলক বিজ্ঞাপনগুলো শতভাগ বাতিল করেছিল ইউটিউব। কিন্তু একই বছরে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে পর্তুগিজ ভাষার গুজবাক্রান্ত নির্বাচনী বিজ্ঞাপনগুলো শতভাগ প্রচার করতে দিয়েছে ইউটিউব।
লন্ডনভিত্তিক গ্লোবাল উইটনেসের ডিজিটাল হুমকিবিষয়ক গবেষক হেনরি পেক বলেন, ‘গবেষণার ফলাফল থেকে এটি স্পষ্ট যে, বিজ্ঞাপনের নীতিমালা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ইউটিউব ধারবাহিকতা মানে না। বিশ্বের কোথায় নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে নীতিমালা প্রয়োগ করে ইউটিউব। আমরা দীর্ঘ সময়ের পর্যবেক্ষণ থেকে দেখেছি, নির্বাচনের সময় বিপজ্জনক, দায়িত্বজ্ঞানহীন ও বিভ্রান্তিমুলক বিজ্ঞাপনগুলো যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যাখ্যান করা হয় কিন্তু ভারতে গৃহীত হয়। এর পেছনে ইউটিউবের কী যুক্তি রয়েছে, তা আমাদের জানা নেই।’
তথ্যসূত্র: টাইম ম্যাগাজিন, অ্যাক্সেস নাউ, গ্লোবাল উইটনেস ও ইকনোমিক টাইমস