বিশ্বের বৃহৎ দুই অর্থনীতির দেশ আমেরিকা ও চীনের বাণিজ্য দ্বন্দ্ব দীর্ঘ দিনের। আর এর প্রভাব পড়ছে বিভিন্ন দেশের ওপর। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ওপর বেশ প্রভাব পড়েছে।
নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞায় আমেরিকা ও ইউরোপের বাজার হারাতে থাকা চীন প্রতিবেশীদের প্রতি দৃষ্টি দিচ্ছে। নিজেদের ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে আশপাশের দেশগুলোয় রপ্তানি বাড়াচ্ছে। এতে করে সেসব দেশের স্থানীয় শিল্পগুলো বড় ধরনের চাপের মুখে রয়েছে, চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না তারা।
এ বিষয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট। সেখানে চীনা রপ্তানি বৃদ্ধিতে কীভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো লোকশানের মুখে পড়ছে তা তুলে ধরা হয়েছে।
থাইল্যান্ডের ব্যাংককে ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশে তৈরি ফ্যাশনেবল পোশাকের ব্যবসা রয়েছে। এমনই একজন পোশাক বিক্রেতা জানান, ব্যবসা আগের মতো চলছে না। মালয়েশিয়াতে অনেকটা একই পরিস্থিতি। চীনের বন্দরগুলোতে আরও বেশি জাহাজ পাঠানোর এবং চীন থেকে আরও বেশি পণ্য আমদানির পরিকল্পনা করছে ইন্দোনেশিয়া।
ওপরের তিনটিই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোটের (আসিয়ান) সদস্য। এসব দেশে গত কয়েক বছরে চীনের পণ্য আমাদানি কয়েক গুণ বেড়েছে। অথচ চীনে দেশগুলোর রপ্তানি কিন্তু বাড়েনি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়া ও বড় ধরনের সরকারি প্রণোদনার অভাবে চীনের আবাসন খাত চরম মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এই পরিস্থিতি বদলাতে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে চীন। এর অংশ হিসেবে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন রপ্তানি পণ্যের উৎপাদন দ্বিগুণ করে দেশটি। এ অবস্থায় ২০২৪ সালে চীনের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় এক-তৃতীয়াংশই আসে রপ্তানি থেকে, যা দেশটির ইতিহাসে ১৯৯৭ সালের পর আর কখনো হয়নি।
চীনে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমা এবং একই সঙ্গে উৎপাদন বাড়ার প্রভাব পড়তে শুরু করে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে। গত তিন বছরে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোয় চীনের রপ্তানি পণ্যের অর্থমূল্য প্রায় ২৪ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু একই সময়ে দেশগুলো থেকে চীনে রপ্তানি না বাড়ায় এসব দেশের সঙ্গে বেইজিংয়ের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যকার বাণিজ্য উত্তেজনা সামাল দিতে অনেক কোম্পানি নিজেদের কারখানা চীন থেকে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোয় সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু দেশগুলোয় চীনের রপ্তানি বাড়ানো থেকে বোঝা যায়, এই চেষ্টা খুব একটা কাজে আসেনি। চীনের কম দামি পণ্যে সয়লাব এসব দেশে বাজার।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের প্রথম নয় মাসে ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় আসিয়ানভুক্ত দেশে চীনের রপ্তানি দুই শতাংশ–পয়েন্ট বেড়েছে। এই ব্যবধানকে আপাত দৃষ্টিতে সমন্বয় করার মতো মনে হয়। কিন্তু আরও খতিয়ে দেখলে এই ব্যবধান যে কাটিয়ে ওঠা বেশ কঠিন তা বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা না।
দুই বছরে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম চীনের প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি ছয় শতাংশ–পয়েন্ট বেড়েছে। একই সময়ে দেশগুলোতে চীনের লোহা ও ইস্পাত রপ্তানি বেড়েছে ১২ শতাংশ–পয়েন্ট। আসিয়ানের দেশগুলোতে চীনের রপ্তানি বাড়লেও একই সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে দেশটির রপ্তানি বাড়েনি।
চীনের রপ্তানি বাড়ায় আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর স্থানীয় কোম্পানি ও উৎপাদকেরা সীমাহীন চাপে আছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে থাইল্যান্ডের কারখানাজাত উৎপাদন প্রায় ১১ শতাংশ কমেছে। ইন্দোনেশিয়ার তৈরি পোশাক শিল্পখাতে ব্যাপক হারে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশটির জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে শিল্পখাতে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ চাকরি হারিয়েছে। চলতি বছর আরও প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার মানুষ চাকরি হারাতে পারে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ছোট কোম্পানিগুলো। তবে বড় কোম্পানিগুলোও রেহাই পাচ্ছে না। ইউরোপ-আমেরিকায় তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান স্ট্রিটেক্স দেউলিয়া হয়ে গেছে। দেউলিয়া হওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক পরিচালক ‘চীনের তৈরি পোশাকশিল্প খাতের অতিরিক্ত রপ্তানিকে’ দায়ী করেছেন।
চীনের রপ্তানি বাড়ায় আসিয়ানের দেশগুলোয় ব্যবসা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। সিঙ্গাপুর ছাড়া এই অঞ্চলের শীর্ষ পাঁচ অর্থনীতির শিল্পজাত উৎপাদন ২০২২ সালের তুলনায় বাড়েনি। আগামীতে এই পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, চীনের উৎপাদন শিল্পের অবিরাম চাপের কারণে এই অঞ্চলের অনেক দেশ ধীরে ধীরে শিল্পহীন বা কারখানাজাত উৎপাদনশূন্য হয়ে পড়তে পারে।
থাইল্যান্ডের বাণিজ্যিক ঋণদানকারী কাসিকর্ন ব্যাংকের বুরিন আদুলওয়াত্তানা বলেন, ‘আমাদের শিল্পের ভিত্তি চীনের মতো প্রতিযোগিতামূলক নয়। আমাদের অর্থ ও জনশক্তি এই দুই মূলধনের ঘাটতি রয়েছে। তাই চলমান ধস ঠেকানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’
ইন্দোনেশিয়ার এক রাজনীতিবিদও একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গত বছর দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রী বলেছিলেন, চীনের লাগামছাড়া রপ্তানির মুখে ছোট কলকারখানাগুলোর ভাগ্যে ‘পতন’ ছাড়া আর কিছু নেই।
তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, রয়টার্স, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস