জার্মানির জাতীয় নির্বাচনে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) জয়ী হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দলটির নেতা ফ্রেডরিখ মের্জ বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসেন। তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প মোটেও ইউরোপের ভাগ্য নিয়ে চিন্তত নন। সুতরাং আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ছিল ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করা।’
মের্জ আরও বলেন, ‘আগামী জুনে নেদারল্যান্ডসে ইউরোপের নেতারা মিলিত হবেন। ততদিন পর্যন্ত ন্যাটোর অবস্থা বর্তমান রূপে থাকবে তো? নাকি ইউরোপকে রক্ষার জন্য আমাদের আরও বিকল্প সক্ষমতা অর্জন করতে হবে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।’
মের্জের এসব বিস্ফোরক মন্তব্য থেকে সহজেই বোঝা যায়, ন্যাটোর ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের আক্রমণ নিয়ে তিনি চিন্তিত।
পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটো প্রায় আট দশক ধরে ইউরোপে শান্তি রক্ষায় ভূমিকা রাখছে। তবে সম্প্রতি ন্যাটোর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ন্যাটোর সাবেক মহাসচিব অ্যান্ডার্স ফগ রাসমুসেন দ্য ইকোনমিস্টের একটি প্রবন্ধে লিখেছেন—‘যে নিরাপত্তা কাঠামোর ওপর ইউরোপ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নির্ভর করে আসছে, তা হারিয়ে গেছে এবং তা সহসা ফিরে আসছে না। ফলে, ইউরোপকে অবশ্যই এই সত্যটি মেনে নিতে হবে যে, আমরা কেবল অস্তিত্বগতভাবে দুর্বলই নই, বরং আপাতদৃষ্টিতে একাও।’
তেতো সত্য বলেছেন অ্যান্ডার্স ফগ। বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা ছাড়া ইউরোপের আত্মরক্ষায় সক্ষম হতে কমপক্ষে এক দশক সময় লাগবে। এটা যে কত বড় চ্যালেঞ্জ, তা ইউক্রেন ইস্যুতে দেখা যাচ্ছে। সেখানে শান্তিচুক্তির জন্য সেনা মোতায়েন করতে চাচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো। কিন্তু এ নিয়ে বিস্তর আলোচনার পর ব্রিটেন ও ফ্রান্স জানিয়েছে, তারা কয়েক হাজারের বেশি সৈন্য মোতায়েন করতে পারবে না। তাও সৈন্যগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, বরং ইউক্রেনের শহর, বন্দর এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে মোতায়েন করা হবে।
এ ধরনের সৈন্য মোতায়েন মূলত তিন ধরনের দুর্বলতা প্রকাশ করে। এক. এটি ইউরোপীয় বাহিনীকে আরও দুর্বল করবে। দুই. এটি ইউরোপের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় গুরুতর ফাঁক তৈরি করবে। তিন. ইউরোপের স্বীকার করে নিতে হবে যে, সৈন্য মোতায়েনের ক্ষেত্রে তাদের মার্কিন সমর্থন প্রয়োজন, বিশেষ করে গোয়েন্দা তথ্য ও বিমান প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে মার্কিন সহায়তা ছাড়া তাড়া টিকতে পারবে না।
ইউক্রেনের জন্য স্বাধীন ডিভিশন-আকারের বাহিনী তৈরি করতে ইউরোপকে ভয়ানক লড়াই করতে হবে। ইউরোপ যদি যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতিতে ন্যাটোর বিদ্যমান যুদ্ধপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায়, তবে তার জিডিপির ৩ শতাংশ ব্যয় করতে হবে প্রতিরক্ষা খাতে। এটি ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের জন্য প্রচলিত ব্যায়ের চেয়ে অনেক বেশি। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ব্রিটেন জানিয়েছে, তারা ২০২৭ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয়ের পরিকল্পনা করছে। কিন্তু ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুট ৩ দশমিক ৭ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার প্রস্তাব করেছেন। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি পূরণের জন্য ৪ শতাংশের বেশি প্রয়োজন হবে।
এদিকে ব্রাসেলসভিত্তিক থিংক-ট্যাংক ব্রুগেল জানিয়েছে, ৩ লাখ মার্কিন সৈন্যর পরিবর্তে ইউরোপকে ৫০টি নতুন ব্রিগেড গঠন করতে হবে, যার মধ্যে অনেকগুলো ‘ভারী’ বর্মযুক্ত ইউনিট থাকতে হবে। এটি প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার।
ইউরোপের অস্ত্র বনাম আমেরিকার অস্ত্র
ব্রুগেল আরও জানিয়েছে, বাল্টিক রাজ্যগুলোতে রুশ বাহিনীর অগ্রগতি ঠেকানোর জন্য ইউরোপের আনুমানিক ১ হাজার ৪০০ ট্যাংক প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া যুদ্ধবিমানও দরকার।
লন্ডনভিত্তিক থিংক ট্যাংক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (রুশি) গবেষক জাস্টিন ব্রংক বলেন, ‘ইউরোপের আধুনিক বিমান বাহিনী আছে বটে এবং তাদের অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানও রয়েছে। কিন্তু শত্রুর বিমান প্রতিরক্ষা ধ্বংস করার মতো কিংবা দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার মতো অস্ত্রের মজুত তাদের নেই।’
জাস্টিন ব্রংক আরও বলেন, ‘কেবল সুইডেনের বিমান বাহিনীই আকাশ পথে যুদ্ধের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ পেয়েছে। তবে গোয়েন্দা তথ্য, নজরদারি, লক্ষ্যবস্তু খুঁজে বের করা ও মূল্যায়ন করার সক্ষমতার জন্য তাদের একচেটিয়াভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করতে হয়।’
আরেকটি স্পষ্ট সমস্যা হচ্ছে, কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের সমন্বয় করা ও নিয়ন্ত্রণ করার মতো দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব দরকার। ন্যাটোর নেতৃত্বে যিনি রয়েছেন, সেই জেনারেল ক্রিস ক্যাভোলিও একজন আমেরিকান।
বড় ধরনের সামরিক বাহিনী পরিচালনার মতো দক্ষতা ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে কেবল ব্রিটিশ ও ফরাসি অফিসারদের মধ্যেই রয়েছে। এখন ইউরোপীয়রা যদি তাদের নিজস্ব বাহিনী তৈরি এবং নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়, তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়—তাদের যুদ্ধাস্ত্র দেবে কে?
গত তিন বছরে ইউরোপে কামান উৎপাদন বেড়েছে। তারপরও উত্তর কোরিয়ার সহায়তায় রাশিয়া এখনো কামান উৎপাদনে ইউরোপের চেয়ে এগিয়ে আছে। প্যান ইউরোপীয় কোম্পানি এমবিডিএর সদর দপ্তর রয়েছে ফ্রান্সে। তারা আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য বিশ্বের সেরা ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে। এ ছাড়া ফ্রান্স, নরওয়ে ও জার্মানির চমৎকার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যদিকে তুরস্কও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা শিল্প-শক্তিতে পরিণত হচ্ছে।
আরেকটি থিংক-ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলেছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইউরোপীয় ন্যাটো রাষ্ট্রগুলো ইউরোপের ভেতর থেকেই ৫২ শতাংশ নতুন অস্ত্র কিনেছে। আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিনেছে মাত্র ৩৪ শতাংশ। তারপরও এই ৩৪ শতাংশই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর মধ্যে রয়েছে রকেট আর্টিলারি ও দীর্ঘ পাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
আমেরিকার ওপর নির্ভরতার মাত্রা সব দেশের এক রকম নয়। যেমন গোয়েন্দা যন্ত্রপাতি ও যুদ্ধাস্ত্রের জন্য আমেরিকার ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল ব্রিটেন। আমেরিকা যদি স্যাটেলাইট চিত্র এবং অন্যান্য ভূ-স্থানিক তথ্য, যেমন ভূখণ্ডের মানচিত্র শেয়ার করা বন্ধ করে দেয়, তাহলে ব্রিটেনের পরিণতি হয়ে ভয়াবহ। গত বছর ইউক্রেন থেকে রাশিয়ায় ব্রিটিশ স্টর্ম শ্যাডো ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি চেয়েছিল ব্রিটেন। কারণ এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য এবং লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য আমেরিকান ভূ-স্থানিক তথ্যের প্রয়োজন।
গবেষক স্যাভিল বলেন, ব্রিটেন যদি প্রতিস্থাপন চিত্র কিনতে চায়, তাকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে অথবা ফ্রান্সের দিকে ঝুঁকতে হবে। এ ছাড়া পারমাণবিক অস্ত্রের জন্যেও ৮০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে আছে ব্রিটেন। রাসমুসেনের দাবি যদি সত্যই হয়, তাহলে পারমাণবিক অস্ত্রের জন্যও ইউরোপকে একা লড়াই করতে হবে।
মের্জ যেমনটা বলেছেন, ‘পারমাণবিক অস্ত্র ও নিরাপত্তা আমাদের জন্যও দরকার। তাই ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনায় বসা প্রয়োজন।’
ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মাত্র ৪০০টি ওয়ারহেড রয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়ার রয়েছে ১ হাজার ৭০০টিরও বেশি ওয়ারহেড। সুতরাং ইউরোপের এত ছোট অস্ত্রাগার দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক ঢালকে প্রতিস্থাপন করার কথা চিন্তাও করা যায় না।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ফ্রান্সের কাছে পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ যুদ্ধবিমান ও সাবমেরিন রয়েছে। সাবমেরিন রয়েছে ব্রিটেনের কাছেও। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র লিজ নেয় ব্রিটেন। কিন্তু সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
তবে এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠা একেবারেই অসম্ভব, তা কিন্তু নয়। ইউরোপের পারমাণবিক সক্ষমতা ও প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ইউরোপীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা গোপনে আলোচনা জোরদার করেছেন। ইউরোপের শীর্ষ পরমাণু বিশেষজ্ঞ ব্রুনো টেরট্রেইস বলেন, ‘ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের এই চ্যালেঞ্জ অবশ্যই মোকাবিলা করতে হবে।’
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ইউরোপের নিজস্ব পুনর্গঠনের জন্যই এখন প্রচুর অর্থ দরকার। তাদের কাছে এখন তাৎক্ষণিক অগ্রাধিকার হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ। এ জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঋণের নিয়ম শিথিল করা, ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা তহবিল গঠনের জন্য বন্ড বাজারকে কাজে লাগানো এবং উন্নয়ন ব্যাংকের আদলে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইউরোপ জোরদার আলোচনা চালাচ্ছে।
ইউরোপের ব্যাংকগুলোতে রাশিয়ার ২১০ বিলিয়ন ইউরো বা ২১৮ বিলিয়ন ডলার সম্পদ জব্দ করা আছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের স্যার জন চিপম্যান বলেছেন, ‘ইউরোপের উচিত রাশিয়ার হিমায়িত সম্পদ জব্দ করা এবং ইউক্রেনের সামরিক ও বেসামরিক অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের কাজে সেগুলো ব্যবহার করা।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা শিল্পে এখন আরও বেশি নগদ বিনিয়োগ করা যেতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়নের যুগে ইউক্রেন ছিল প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনের শক্তিশালী কেন্দ্র। ইউক্রেনকে আবারও তেমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। ডেনমার্ক এরই মধ্যে ইউক্রেন সরকার ও স্থানীয় অস্ত্র প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি দাবি করেছেন, রণাঙ্গনে চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ দেশীয় অস্ত্রের মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে। বাকি অস্ত্রের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে জার্মানির রাইনমেটাল এবং ফ্রাঙ্কো-জার্মান সংস্থা কেএনডিএসের মাধ্যমে। সমরবিদ স্যার লরেন্স ফ্রিডম্যান বলেছেন, ‘ইউক্রেন বিভিন্ন আকারের ড্রোন, কামান ও বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক যুদ্ধাস্ত্র তৈরিতে মনযোগ দিয়েছে।’
এত কিছুর পরেও, আমেরিকা ইউক্রেনকে ছেড়ে গেলে ইউরোপ বিপদে পড়বে বলেই বিশ্লেষকদের মত। তাঁদের মতে, ইউরোপের প্রতিরক্ষা শিল্পগুলো সম্প্রসারিত হচ্ছে বটে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের শূন্যস্থান পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়।
‘হু উইল ডিফেন্ড ইউরোপ’ বইয়ের লেখক কেয়ার গাইলস বলেছেন, ‘ইউক্রেনে শান্তিচুক্তি না হওয়ার জন্য ট্রাম্প এখন জেলেনস্কিকে দায়ী করতে পারেন এবং মার্কিন সংস্থাগুলোকে ইউক্রেনে অস্ত্র রপ্তানিতে বাধা দিতে পারেন। ইউরোপের জন্য এই শূন্যতা পূরণ করা অত্যন্ত কঠিন হবে।’
এসব কারণ বিবেচনা করেই সম্ভবত ফ্রেডরিখ মের্জ বলেছেন, ‘ইউরোপে গভীর অন্ধকার নেমে আসতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি!’
তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, বিবিসি, রয়টার্স , ডয়চে ভেলে ও এএফপি