শুল্ক নিয়ে নিজের মতো করে খেলে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে চীনকে প্রধান মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হলেও কানাডার ওপরও বেশ প্রভাব পড়ছে। এমনকি কানাডাকে অঙ্গরাজ্য করার প্রস্তাব করে আসছেন ট্রাম্প। এ নিয়ে একের পর এক প্রস্তাব দিয়ে আসছেন এই নেতা। এবার যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি বাতিল করে কানাডা কি আমেরিকাকে শিক্ষা দেবে?
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ বলছে, আমেরিকার কাছ থেকে ৮৮টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি করেছিল কানাডা। ২০২৩ সালে আমেরিকা ও মার্কিন অস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিনের সঙ্গে একটি চুক্তিও চূড়ান্ত করে উত্তর আমেরিকার দেশটি। এবার সেই চুক্তি পর্যালোচনার নির্দেশ দিয়েছেন কানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘শুল্ক যুদ্ধ’ এবং মিত্র দেশে প্রতিরক্ষা নিশ্চয়তা নিয়ে সংশয় দেখা দেওয়ার পর এই সিদ্ধান্ত নিল কানাডা প্রশাসন। এই চুক্তি পর্যালোচনার নির্দেশ দিয়ে কানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি বলেন, আর কোনো বিকল্প রয়েছে কি না, তা যেন বের করা হয়।
এমনটাই বলছেন কানাডার প্রতিরক্ষা বিভাগের এক মুখপাত্র। ২০২৩ সালে করা এই চুক্তির আওতায় ১৬টি যুদ্ধবিমান কেনার বৈধতাও রয়েছে কানাডার। এ জন্য এরই মধ্যে অর্থও দেওয়া হয়ে গেছে। চুক্তি বাতিল করা হলে সবই গচ্চা যাবে। তবে এ ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে কানাডা প্রশাসন।
কানাডার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলছেন, ‘স্পষ্টভাবেই বলছি, এখনো এই চুক্তি বাতিল করা হয়নি। কিন্তু চুক্তি নিয়ে আমাদের কিছু কাজ রয়েছে। বিশেষ করে পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে আমাদের কিছু হোমওয়ার্ক দরকার। কানাডীয় ও কানাডার সশস্ত্র বাহিনীর জন্য সেরা বিকল্পই আমরা বেছে নেব।’
কানাডীয় পণ্যে ট্রাম্প ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর এই অবস্থান নিয়েছে কানাডা। নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি শুধু এই সিদ্ধান্ত নিয়েই থেমে থাকেননি। বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি প্রথম সফরে আমেরিকায় যাননি, গিয়েছেন ইউরোপ। প্রথমে ইউরোপের ফ্রান্সে যাওয়ার পরও তিনি আমেরিকায় যাবেন না, যাবেন লন্ডন। আমেরিকার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে শুরু থেকেই নতুন ভাবনায় প্রবেশ করেছেন মার্ক কার্নি।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইনডিপেনডেন্ট বলছে, ৮৮টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তিতে ব্যয় হওয়ার কথা ১ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। এই চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে তাদের খরচ পড়বে ৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। রয়্যাল কানাডীয় এয়ারফোর্স গত ৩০ বছরে এত বিশাল আকারের কোনো বিনিয়োগ করেনি।
এ ব্যাপারে মার্কিন অস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিনের এক মুখপাত্র বলছেন, রয়্যাল কানাডীয় এয়ারফোর্সের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বহুদিনের। তারা এই সম্পর্কের মূল্য দেয়। এই চুক্তি নিয়ে কানাডীয় প্রশাসনের মধ্যে যে প্রশ্ন এসেছে, তার সমাধান আমেরিকা ও কানাডার সরকারই করবে।
শুল্ক নিয়ে প্রশ্ন নাকি ‘কিল সুইচ’?
ট্রাম্পের শুল্কারোপের কারণেই কানাডা এই অবস্থান নিয়েছে–এমন বলা যাচ্ছে না। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান নিয়ে গত সপ্তাহে উদ্বেগ প্রকাশ করে জার্মান কর্তৃপক্ষ। তারা ‘কিল সুইচের’ কথা উল্লেখ করছে। কিল সুইচ হচ্ছে এমন একটি মেকানিজম, যার মাধ্যমে কোনো সমরাস্ত্র জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করা যায়। এতে ওই অস্ত্রের কোনো ক্ষতি হয় না। জার্মানি বলছে, এর মাধ্যমে সমরাস্ত্র যেকোনো সময় বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে। যন্ত্রে থাকা বন্ধ করার অপশন ব্যবহার করতে হয় না।
এই ইস্যুতে সংশয় প্রকাশ করেছে পর্তুগালও। তারা বলছে, বর্তমানে মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে আমেরিকা যে আচরণ করছে, সে কারণে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার ব্যাপারে দ্বিতীয়বার ভাবতেই হচ্ছে। পর্তুগালের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নুনো মেলো গত বৃহস্পতিবার এ নিয়ে উদ্বেগও জানান। তিনি বলেন, আকাশযান ব্যবহারের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে পারে আমেরিকা। কেননা এসব যান তাদের নিজেদের মতো করে বানানো। এ জন্য বিকল্প নিয়ে ভাবছে পর্তুগাল।
এই ‘কিল সুইচ’ নিয়ে সম্প্রতি এমন আরও ‘গুজব’ ছড়াচ্ছে। আর এসব গুজব শুধু যে আড়ালে হচ্ছে, এমন নয়। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি নিয়ে নতুন করে ভাবছে। ইউক্রেনে আমেরিকার পাঠানো এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান হুট করেই যুদ্ধক্ষেত্রে বন্ধ হয়ে যায়। গত সপ্তাহে এ ধরনের সংবাদ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর থেকে এই তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে যে, এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান যেকোনো সময় অকেজো করে দেওয়ার মেকানিজম রয়েছে আমেরিকার হাতে।
তবে এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন জার্মান অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হেনসল্ডের কমিউনিকেশন্স বিভাগের প্রধান জোয়াসিম স্ক্র্যানজোফার। তিনি জার্মান সংবাদমাধ্যম বিল্ডকে বলেন, এই কিল সুইচ নিয়ে যে তথ্য ছড়াচ্ছে, তা গুজব ছাড়া কিছুই নয়।
কিল সুইচ হোক, শুল্ক হোক কিংবা আমেরিকার হুমকি–কোনো না কোনো কারণে কানাডা এবার নিজেদের মতো ভাবতে শুরু করেছে। অন্য কোনো দেশ এসে কখনো তাদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না–কানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নির পদক্ষেপে মনে হচ্ছে তিনি এটা বুঝতে পেরেছেন। সে কারণেই অন্য দেশের ওপর নির্ভর করার দিকে যাচ্ছেন না এই নেতা। সামনে আর কী কী পদক্ষেপ নিতে পারেন তিনি, আর কী কী প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন ট্রাম্প–সেটিই এখন দেখার বিষয়।