২০২২ সালে রাশিয়া যখন ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রায় হামলা শুরু করে তখন জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কিশিদা ফুমিও উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আজ ইউক্রেন আক্রান্ত হয়েছে, আগামীকাল পূর্ব এশিয়া আক্রান্ত হতে পারে। এমনকি চীন দখল করে নিতে পারে তাইওয়ান।’
তিন বছর পর কিশিদার আশঙ্কা নতুন করে আলোচনায় এসেছে, কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউক্রেনের ওপর চাপ বাড়াচ্ছেন। তিনি এরই মধ্যে ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সকল সহযোগিতা বন্ধ ঘোষণা করেছেন। অর্থাৎ ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আর কোনো সামরিক ও মানবিক সহায়তা যাবে না।
বলে রাখা ভালো, ইউক্রেনে গত তিন বছরে ৩২০ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩৯ লাখ কোটি টাকা!
সেই আমেরিকা যদি এখন এশিয়ার মিত্র দেশগুলোর দিক থেকেও মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে কী হবে?
বিশ্লেষকদের ধারণা, আমেরিকা যদি চীনকে হুমকি হিসেবে দেখে, তাহলে অচিরেই এশিয়ার বন্ধুদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না আমেরিকা।
তাইওয়ানের প্রধানমন্ত্রী সু সেং চং এই মাসের শুরুর দিকেও একই ধরনের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমেরিকা সম্ভবত ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ত্যাগ করার ঝুঁকি নেবে না।’
আমেরিকায় নিযুক্ত জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত সেসে কেনেচিরো বলেছেন, আমেরিকা যে এশিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না, তার বড় উদাহরণ হচ্ছে, সম্প্রতি ইউএসএআইডির সহায়তা বন্ধের পদক্ষেপ থেকে তাইওয়ান এবং ফিলিপাইনের জন্য নিরাপত্তা সহায়তা অব্যাহত রাখা। মনে রাখতে হবে, এশিয়ার পরিস্থিতি ইউরোপ থেকে আলাদা। এই অঞ্চলে আমেরিকার জন্য সবচেয়ে বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকির নাম হচ্ছে চীন।
এশিয়ার বিভিন্ন মিত্র দেশে আমেরিকার কয়েক ডজন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। আর ঘাঁটিগুলোতে রয়েছে প্রায় ৯০ হাজার মার্কিন সৈন্য। ইউরোপ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর কূটনীতি বদলে ফেলেছেন বলে দৃশ্যমান হলেও এশিয়া বিষয়ে তাঁর কূটনীতির পরিবর্তন দৃশ্যমান নয়। এশিয়া চলছে আগের নিয়মেই। যেমন ওভাল অফিসে ইউক্রেনের প্রসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে তীব্র বাগবিতন্ডার দুই দিন পরেই দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বন্দরে আমেরিকার পূর্ব–নির্ধারিত একটি উড়োজাহাজ অবতরণ করেছে। অর্থাৎ সবকিছু আগের মতোই। স্বাভাবিক।
তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বাগবিতণ্ডার পর এশিয়ার মিত্র দেশগুলোও সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাওয়ার মতো দশায় পড়েছে। তারাও ট্রাম্পের ব্যাপারে সতর্ক হচ্ছেন। যেমন দক্ষিণ কোরিয়ার একজন আইনপ্রণেতা আহন চিওল সু বলেছেন, ‘ট্রাম্প ও জেলেনস্কির বাগবিতণ্ডা থেকে এটি স্পষ্ট যে, দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার ওপরেও যেকোনা সময় আঘাত আসতে পারে।’
তবে কোনো কোনো বিশ্লেষক এমন আশঙ্কার কথাও বলছেন যে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি ট্রাম্প খুব সম্ভবত চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করবেন।
ট্রাম্প খুবই ‘আনপ্রেডিকটেবল লিডার’। তাঁর ব্যাপারে কখনোই পূর্ব অনুমান করা যায় না। হয়তো এশিয়ার মিত্র দেশগুলোও তাঁর লেনদেনবাদ থেকে রেহাই পাবে না। চলতি মাসেই তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার শুল্ক নীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন। আবার জাপানের ব্যাপারে বলেছেন, ‘আমেরিকার সঙ্গে জাপানের জোট খুবই অন্যায্য। এটাকে সমতা আনতে হবে।’
এমন পরিস্থিতিতে এশিয়ার মার্কিন মিত্ররা কী করতে পারে? প্রথমত, তারা ট্রাম্পের কৃপাপ্রার্থী হয়ে থাকারই চেষ্টা করবে। এ ক্ষেত্রে তারা আমেরিকায় নতুন বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিতে পারে। ট্রাম্প চান, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া আলাস্কা থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করতে একটি নতুন পাইপলাইন ব্যবহার করুক।
আরেকটি বিষয় ভেবে দেখা দরকার। এশিয়ার মিত্র দেশগুলোর নিরাপত্তা ব্যয় কতটুকু। এশিয়ায় আমেরিকার মিত্র দেশগুলো যেমন—অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া ও থাইল্যান্ডের প্রতিরক্ষা ব্যয় চীনের প্রতিরক্ষা ব্যয়ের অর্ধেকেরও কম। এই মিত্র দেশগুলো যদি চীনের সমান প্রতিরক্ষা ব্যয় করতে চায়, তাহলে তাদের প্রতিরক্ষা খাতে জিডিপির ৩ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি ব্যয় করতে হবে।
জাপান ধীরে ধীরে তার প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াচ্ছে। যেমন ২০২৭ সালের মধ্যে তারা প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির ২ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়েছে। বলে রাখা ভালো, এ ক্ষেত্রে কেবল দক্ষিণ কোরিয়াই প্রতিরক্ষা খাতে তার জিডিপির ২ শতাংশ ব্যয় করে থাকে।
অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া চেষ্টা করছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় নৌবহর তৈরি করার। তবে অস্ট্রেলিয়া যে পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরি করতে চাচ্ছে, সেটির জন্যও আমেরিকার ওপর নির্ভর করতে হবে। আবার জাপান দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে বটে, তবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য প্রয়োজনীয় গোয়েন্দা তথ্যের জন্য সেই আমেরিকার ওপরেই নির্ভর করতে হবে।
সুতরাং এ কথা পরিষ্কার যে, এশিয়ার মিত্র দেশগুলো নিরাপত্তাখাতে শক্তিশালী হয়ে উঠলেও, তা এখনো আমেরিকার শক্তির পরিপূরক হয়ে ওঠেনি।
তাই এশিয়ার দেশগুলো চেষ্টা করছে, ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গেও সহযোগিতা বাড়ানোর। যেমন: ফ্রান্স প্রায় ৫০ বছর পর সম্প্রতি প্রথমবারের মতো প্রশান্ত মহাসাগরে একটি বিমানবাহী স্ট্রাইক গ্রুপ পাঠিয়েছে। আবার দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই মাসেই ইউরোপ সফরে যাচ্ছেন।
যাই হোক, জাপানের একজন সাবেক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আমেরিকা যদি এশিয়ার মিত্র দেশগুলোর ওপর থেকে ছাতা সরিয়ে নেয়, সেক্ষেত্রে চীন অবধারিতভাবেই এশিয়ার ওপর আধিপত্য বিস্তার করবে।’
এই পরিস্থিতিতে, এশিয়ার মিত্র দেশগুলোর কেউ কেউ চীনের দিকে ঝুঁকবে। কেউ কেউ নিরাপত্তার নিশ্চয়তার প্রয়োজনে নিজেরাই পারমাণবিক অস্ত্রাগার তৈরির দিকে মন দিতে পারে। গত কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ কোরিয়ায় এ ধরনের আলোচনা জোরদার হয়েছে। এমনকি পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী বামপন্থী ডেমোক্র্যাটিক নেতারাও পরমাণু অস্ত্রতে বলীয়ান হওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন।
এমনকি পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী জাপান, যাদের শরীরের এখনো হিরোশিমা এবং নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলার স্মৃতি দগদগে ক্ষত হয়ে আছে, তারাও পারমাণবিক অস্ত্রে সক্ষমতা অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাবছে। জাপান সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র দ্য ইকোনমিস্টকে বলেছে, ‘পারমাণবিক অস্ত্র এমন একটি বিষয় যা নিয়ে জাপানের আলোচনা করা উচিত।’
তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএন ও বিবিসি