ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার চলমান সংঘাত তৃতীয় দিন পার করেছে। কিন্তু এই সংঘাত আর এই দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। নানাভাবে জড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের অন্যান্য পরাশক্তিগুলো। এর মধ্যে মুখ্য ভূমিকায় যেমন আছে চীন, তেমনি আছে তার প্রতিপক্ষ আমেরিকা ও এর পশ্চিমা মিত্ররা।
কীভাবে? দক্ষিণ এশিয়ার এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়া পাকিস্তান তার সামরিক বাহিনীর জন্য ৮১ শতাংশ অস্ত্র কেনে চীন থেকে। গত ৫ বছর ধরে এমনটাই হয়ে আসছে। আর ভারত? ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় অস্ত্রক্রয়কারী দেশ। দেশটি তার অত্যাধুনিক অস্ত্রের অর্ধেকের বেশি কেনে আমেরিকা ও তার মিত্রদের কাছ থেকে। ফলে প্রতিবেশি দুই দেশের বর্তমান সংঘাত আসলে চীন ও পশ্চিমা দেশগুলোর যুদ্ধ-প্রযুক্তির পরীক্ষাগারে পরিণত হয়েছে। কে কাকে ঘায়েল করল–এই হিসাব ভারত ও পাকিস্তানকে যেমন আন্দোলিত করছে, তেমনি সুখের সাগরে ভাসাচ্ছে–আবার ভাবাচ্ছে চীন, আমেরিকা, ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশকে।
ভিডিও দেখুন:
বিশেষ করে চীনকে। চীনের ফোর পয়েন্ট ফাইভ জেনারেশনের জে–টেন সি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করছে পাকিস্তান। এই যুদ্ধবিমান থেকে হামলা চালিয়ে ভারতের অত্যাধুনিক ফ্রান্সের তৈরি রাফাল, রাশিয়ার তৈরি সুকোই-৩০ ও মিগ–২৯ কে ভূপাতিত করেছে বলে দাবি করে পাকিস্তান। ঘটনাটি ছিল মঙ্গলবার দিবাগত রাতের। এখন পর্যন্ত ভারতীয় পক্ষ এই ধরনের ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করেনি। যদিও ফরাসি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে সিএএন-এর খবরে বলা, রাফাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে সংখ্যা কত তা তারা জানেন না।তারপরেও বুধবার সকালেই সেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জে জে–টেন সি যুদ্ধবিমান উৎপাদক প্রতিষ্ঠান এভিআইসি চেংগুডু এয়ারক্রাফটের শেয়ারের দাম বেড়ে যায় ১৭ শতাংশ। আর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাফাল ভূপাতিত সংক্রান্ত দাবি পরদিন বৃহস্পতিবার এই শেয়ারের দাম আরও ২০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। আর এ বিষয়ে পাকা প্রমাণ পাওয়ার আগেই চীনা নাগরিক ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্বে আগ্রহীদের খুশির বন্যা বয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
আসলে চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দীর্ঘদিন ধরে সামরিক বাহিনীর আধুনীকিকরণে হাত দিয়েছেন। আর এই আধুনিকতা আসছে উচ্চ প্রযুক্তির হাত ধরে। প্রেসিডেন্ট শি জানেন, তাদের প্রতিপক্ষ আর কেউ না, আমেরিকা। আর প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব বর্তমান বিশ্বে প্রশ্নাতীত। তাই সংখ্যার চেয়ে মানের ওপর জোর দেন তিনি। কিন্তু গত দুই দশক ধরে চীন এই কাজটি করছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। তাদের অগ্রগতি কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায় না।
তবুও চীন গত চার দশকের বেশি সময় কোনো ধরনের যুদ্ধে জড়ায়নি। ফলে বাস্তবের মাটিতে তার নতুন অস্ত্রের আসলে কোনো পরীক্ষাও হয়নি। যেমনটি আমেরিকা ও তার ইউরোপিয় মিত্ররা করেছে ইরাকে, আফগানিস্তানে, লিবিয়ায়। বর্তমানে গাজায়। রাশিয়া করছে ইউক্রেনে। সেদিক বিবেচনায় চীনের জন্য পাকিস্তানের যুদ্ধ-সক্ষমতা এক বিরাট পরীক্ষা। ভারত এর সরাসরি ভুক্তভোগী দেশ। কিন্তু পশ্চিমারা শ্যেণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রত্যেকটি চীনা অস্ত্রের কার্যকারিতার দিকে।
কারণ চীনের আছে পঞ্চম প্রজন্মের জে–টোয়েন্টি যুদ্ধবিমান। যা আমেরিকার তৈরি এফ–৩৫ এর সমান বলে দাবি করা হয়। এমনও প্রচার আছে যে, চীন ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরি করে ফেলেছে। যা জে–৩৬ নামেই পরিচিত। ২০৩০ সালে এই যুদ্ধবিমান যুক্ত হবে চীনের সামরিক বাহিনীতে। চীনের এই অস্ত্রশস্ত্রের বিষয়টি এতই গোপন যে তাদের প্রতিপক্ষ তেমন কোনো ধারনা পায় না। এ কারণে পাকিস্তানের ব্যবহৃত চীনা অস্ত্রের দিকে অতি আগ্রহ সারা বিশ্বের।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, পাকিস্তান চীনের কাছ থেকে উন্নত যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, রাডার এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছে। যা পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে মধ্যেকার চলমান সামরিক সংঘাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এমনকি পাকিস্তান চীনের সহযোগিতায় যৌথভাবে বেশ কিছু অস্ত্র তৈরি করেছে। এগুলো আদপে চীনেরই প্রযুক্তি।
এ কারণে লন্ডনভিত্তিক একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এশিয়া-প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিচালক সজ্জন গোয়েলের মতে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যেকোনো সংঘাত চীনা সামরিক সরঞ্জামের জন্য একটি বাস্তব পরীক্ষার পরিবেশ করে তোলে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অফ ডেমোক্রেসিজের সিনিয়র ফেলো ক্রেগ সিঙ্গেলটন বলছেন, এটি এখন আর কেবল দ্বিপাক্ষিক সংঘর্ষ নয়; এটি চীনা প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানি কীভাবে আঞ্চলিক প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নতুন রূপ দিচ্ছে তার একটি আভাস।
ভিডিও দেখুন:
পাকিস্তানের কাছে কিন্তু আমেরিকান এফ সিক্সটিন যুদ্ধবিমানও আছে। যদিও তা অনেক পুরোনো। এরপরে লকহিড কোম্পানি তাদের এই যুদ্ধবিমানকে অনেকটাই আপগ্রেড করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের কাছে রয়ে গেছে পুরোনো মডেলই। ফলে পাকিস্তান এখন মার্কিন অস্ত্র বাদ দিয়ে চীনের আধুনিক অস্ত্রের ওপর ভরসা করছে। বেইজিংয়ের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজির সিনিয়র ফেলো অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ঝো বো মনে করেন, যদি চীনের তৈরি জে-১০সি যুদ্ধবিমান ফ্রান্সের তৈরি রাফাল ভূপাতিত করার জন্য সত্যিই ব্যবহার করা হয়ে থাকে তাহলে এটি হবে চীনা অস্ত্রের প্রতি আস্থা বৃদ্ধির বিরাট ঘটনা। তাঁর মতে, এ ঘটনায় শুধু মানুষের ভ্রু কুঁচকে যাবে না; আন্তর্জাতিক বাজারে চীনা অস্ত্র বিক্রির জন্য সম্ভবনাও বিশাল বাড়বে।বিশ্ববাজারে অস্ত্রের সবচেয়ে বড় বিক্রেতা আমেরিকা। ৪১ শতাংশ বাজার তার দখলে। ১০ শতাংশের কাছাকাছি বাজার দখল করে এরপরই আছে ফ্রান্স। তারপর রাশিয়া। আর চতুর্থ স্থানে চীন। আর চীনের অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা পাকিস্তান। এখন নিজের অস্ত্রের দক্ষতা প্রমাণ করতে পারলে চীন হয়তো মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বাজারে ভাগ বসাতে পারবে। সেক্ষেত্রে রাশিয়ার বাড়া ভাতে চাই পড়তে পারে। সেজন্য পাকিস্তানের রাফাল, সুকোই ভূপাতিত করার দাবির ব্যাপারে ম্যাকাও-ভিত্তিক সামরিক পর্যবেক্ষক অ্যান্টনি ওং ডং বলছেন, এটা চীনের জন্য একটি বিশাল বিজ্ঞাপন। কারণ বিশ্বে বছরে ১২০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রের বাজার ধরার ব্যাপারে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
তবে পাকিস্তানের সাফল্য দাবি; চীনের স্বপ্ন–সবকিছুর মধ্য অনেকগুলো যদি ও কিন্তু আছে। পশ্চিমারা কিন্তু বসে নেই। পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথম দিন ভারত যে এতগুলো জায়গায় ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালাল, তা ঠেকাতে পারল না কেন পাকিস্তান। কারণ তাদের কাছে তো চীনের তৈরি অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে? লন্ডনের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ সজ্জন গোয়েলের দাবি, যদি চীনের তৈরি রাডার বা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ভারতীয় আক্রমণ শনাক্ত করতে বা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়, তবে এটি বেইজিংয়ের অস্ত্র রপ্তানির বিশ্বাসযোগ্যতার জন্যও খারাপ।
আর রাফাল বা সুকোই ভূপাতিত করার ব্যাপারে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এটা যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে তা ওই যুদ্ধবিমানের জন্য হয়নি, হয়েছে ভারতের বিমানবাহিনীর ভুলে। তারা ঠিক মতো প্রস্তুতি নেয়নি। ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অফ ডেমোক্রেসিজের বিশ্লেষক ক্রেগ সিঙ্গেলটন বলছেন, ভারত যদি একাধিক যুদ্ধবিমান হারায় তাহলে এটি তার বিমানবাহিনীর প্রস্তুতি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করবে। রাফাল আধুনিক। কিন্তু তার টিকে থাকার বিষয়টি নির্ভর করবে ব্যবহারের ওপর।
ভিডিও দেখুন:
বিশেষজ্ঞরা অনেক কিছুই বলছেন। তবে এটা ঠিক যে, ভারত-পাকিস্তান চলমান সংঘাত চীনের অস্ত্রের জন্য একটা বিরাট পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।তথ্যসূত্র: সিএনএন