ইরান কয়েক সপ্তাহ না হলেও কয়েক মাসের মধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হবে–এমন একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে শঙ্কিত হয়ে পড়ে ইসরায়েল। এরপর ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করার লক্ষ্যে একটি বিশাল বিমান অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী।
ইসরায়েলের বিমান হামলা ইরানের নাতাজে অবস্থিত প্রধান পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, সেইসাথে এর বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনাগুলোতে আঘাত হেনেছে।
এই হামলায় নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ইরানের শক্তিশালী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রধান হোসেন সালামি; সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মোহাম্মদ বাঘেরি এবং দুইজন বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানি।
এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ‘কঠোর শাস্তির’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইরান সম্ভবত ইসরায়েলের পারমাণবিক কেন্দ্র এবং পারস্য উপসাগরের থাকা মার্কিন ঘাঁটিগুলোকে লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিতে পারে। ইসরায়েল দাবি করেছে, হামলার কয়েক ঘণ্টা পরেই ইরান তাদের দিকে এক শটি ড্রোন নিক্ষেপ করেছে।
মধ্যপ্রাচ্য আবারও একটি সম্ভাব্য বিধ্বংসী যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে, যার গুরুতর আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাব রয়েছে।
স্থবির পারমাণবিক আলোচনা
ইসরায়েলের এই অভিযান আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে চলা অসম্পূর্ণ থাকা পারমাণবিক আলোচনার পটভূমিতে হয়েছে। এই আলোচনা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুরোধে এপ্রিলের মাঝামাঝি শুরু হয়েছিল এবং এর লক্ষ্য ছিল কয়েক মাসের মধ্যে একটি চুক্তিতে পৌঁছানো।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অবশ্য এই আলোচনার বিরোধিতা করেছিলেন। এর পরিবর্তে তিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করার সেরা বিকল্প হিসেবে সামরিক পদক্ষেপের ওপর জোর দিয়েছিলেন।
সাম্প্রতিক সময়ে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা স্থবির হয়ে পড়ে ট্রাম্পের একটি দাবির কারণে। তার দাবি ছিল, ইরান শূন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ নীতিতে সম্মত হোক এবং ৬০% বিশুদ্ধতার প্রায় ৪০০ কিলোগ্রাম সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত ধ্বংস করুক। এই ইউরেনিয়াম দ্রুত আরও সমৃদ্ধ করে অস্ত্র তৈরির স্তরে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
তেহরান তাতে অসম্মতি জানায় এবং বলে, এটা আলোচনাযোগ্যই নয়।
নেতানিয়াহু দীর্ঘদিন ধরে ইরানের ‘অক্টোপাস’ নির্মূল করার অঙ্গীকার করে আসছেন। আর এটি হলো ইরানের বিশাল আঞ্চলিক সহযোগী নেটওয়ার্ক, যার মধ্যে গাজার হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ, সিরিয়ার সাবেক নেতা বাশার আল-আসাদের শাসন এবং ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা অন্তর্ভুক্ত।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েলে হামলার পর, ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী একের পর এক ব্যবস্থা নিয়ে ইরানের এই সহযোগী সংগঠনগুলোকে যথেষ্ট দুর্বল করে দিয়েছে। এখন নেতানিয়াহু অক্টোপাসের মাথা কেটে ফেলার জন্য অগ্রসর হয়েছেন।
ট্রাম্প দূরত্ব বজায় রাখছেন
নেতানিয়াহু অতীতে ওয়াশিংটনকে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে তার সাথে যোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তবে মার্কিন নেতারা মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ শুরু করা বা তাতে জড়িত হওয়াকে কাম্য মনে করেননি। বিশেষ করে ইরাকে বিপর্যয় এবং আফগানিস্তানে তাদের ব্যর্থ হস্তক্ষেপের পর।
আবার ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি তার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্প দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে এই মার্কিন অবস্থান অনুসরণ করতে আগ্রহী ছিলেন।
ট্রাম্প ভোলেননি যে, ২০২০ সালে তাকে হারিয়ে জয়ী জো বাইডেনকে নেতানিয়াহুর উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
ট্রাম্প তেল-সমৃদ্ধ আরব দেশগুলোর সাথে তার লাভজনক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য নেতানিয়াহুর সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জোটবদ্ধ হতে আগ্রহী ছিলেন না। সম্প্রতি তিনি মধ্যপ্রাচ্য সফরে ইসরায়েলকে বাদ দিয়ে সৌদি আরব, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন।
বস্তুত, এই সপ্তাহে ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে এমন কিছু না করার জন্য সতর্ক করেছিলেন যা ইরানের সঙ্গে আমেরিকার পারমাণবিক আলোচনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত খুব একটা ভালো ফল না করা সত্ত্বেও, শান্তি স্থাপনকারী হিসেবে নিজের ঘোষিত খ্যাতি বাড়াতে ট্রাম্প একটি চুক্তি সই করতে আগ্রহী ছিলেন।
কিন্তু পারমাণবিক আলোচনা যখন একটি অচলাবস্থায় পৌঁছাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল, তখন নেতানিয়াহু সিদ্ধান্ত নিলেন যে এখনই হামলার কাজটা করার সময়।
ট্রাম্প প্রশাসন এই হামলা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছে, বলছে যে তারা এতে জড়িত ছিল না। এখন দেখার বিষয় যে, ইরান যদি এবং যখন প্রতিশোধ নেয়, তখন আমেরিকা ইসরায়েলকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে কিনা।
একটি বৃহত্তর যুদ্ধের অর্থ কী হতে পারে
ইসরায়েল দেখিয়েছে যে, তাদের কাছে বিপুল পরিমাণ সামরিক শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা রয়েছে, যা ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা এবং অবকাঠামোর গুরুতর ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু ইরানের ইসলামিক শাসনেরও প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে, তাদের হাতে থাকা সব পন্থা তারা ব্যবহার করবে।
ইরানের নেতৃত্ব রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুতর অভ্যন্তরীণ সমস্যার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও, তাদের কাছে এখনো উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন আছে, যা ব্যবহার করে এই অঞ্চলে ইসরায়েলি ও মার্কিন সম্পদকে লক্ষ্যবস্তু করার ক্ষমতা রয়েছে।
এছাড়া ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, যার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী তেল এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের ২০-২৫% সরবরাহ হয়ে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইরানের রাশিয়া ও চীনের সাথে কৌশলগত অংশীদারত্ব রয়েছে।
ইরানের প্রতিক্রিয়ার প্রকৃতি ও পরিধির ওপর নির্ভর করছে বর্তমান সংঘাত সহজেই একটি অনিয়ন্ত্রণযোগ্য আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে কিনা, যেখানে কোনো পক্ষই আসলে বিজয়ী গতে পারবে না। একটি বড় সংঘাত কেবল অস্থির মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অস্থিতিশীল করবে না, বরং ভঙ্গুর বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকেও উল্টে দিতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্য আরেকটি যুদ্ধের বোঝা টানতে পারবে না। পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলার সময় নেতানিয়াহুর সরকারকে সংযত রাখার যথেষ্ট কারণ ছিল ট্রাম্পের। কারণ এটা হলেই তিনি একটি চুক্তি করে ফেলতে পারতেন।
এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে এই চুক্তিটি রক্ষা করা যাবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। আলোচনার পরবর্তী দফা রোববার ওমানে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইরান জানিয়েছে, তারা তাতে অংশ নেবে না এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সমস্ত আলোচনা বন্ধ থাকবে।
বারাক ওবামার অধীনে ইরান ও আমেরিকা এর আগে একটি পারমাণবিক চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল– জয়েন্ট কম্প্রিহেন্সিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (JCPOA)। যদিও নেতানিয়াহু এটিকে ‘শতাব্দীর সবচেয়ে খারাপ চুক্তি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ট্রাম্প নেতানিয়াহুর অনুরোধে ২০১৮ সালে একতরফাভাবে এই চুক্তি থেকে সরে আসেন।
এখন, নেতানিয়াহু ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি গুড়িয়ে দিতে সামরিক পথ বেছে নিয়েছেন। এই সিদ্ধান্ত এই অঞ্চল ও বাকি বিশ্বের জন্য একটা বড় পরীক্ষা যে, খুব দেরি হওয়ার আগে আরেকটি যুদ্ধ এড়ানো যায় কিনা।
লেখক: মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশীয় গবেষণার ইমেরিটাস অধ্যাপক, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং ভাইস চ্যান্সেলরের স্ট্র্যাটেজিক ফেলো, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি।