ইরানে গত শুক্রবার ইসরায়েলি বিমান হামলার পর পাল্টা জবাবে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছুড়েছে তেহরান। এর মধ্যে কিছু ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ করে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। ইরানের কিছু হামলা ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চলের আবাসিক এলাকায় আঘাত হেনেছে, যাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এমনকি তেল আবিবে অবস্থিত সুরক্ষিত ইসরায়েলি সামরিক সদর দপ্তর কিরিয়াতেও হামলা করেছে ইরান।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা বলছে, গত মঙ্গলবার ইরান দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা কেন্দ্র ও গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একটি পরিকল্পনা কেন্দ্রে আঘাত হেনেছে। এর মাধ্যমে ইসরায়েলের সবচেয়ে উন্নত ও বিশ্বের সর্বাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও ভেদ করতে সক্ষম হয়েছে তারা।
সাম্প্রতিককালের ইতিহাস বলছে, ইসরায়েল আয়রন ডোমের মতো আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাগুলোর মাধ্যমে বেশির ভাগ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সফলভাবে প্রতিহত করেছে। তাহলে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র কীভাবে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ করছে?
আল-জাজিরার প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অ্যালেক্স গ্যাটোপুলোস বলছেন, ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে আয়রন ডোম। তবে এটি একটি বৃহত্তর বহুস্তর ও সমন্বিত প্রতিরক্ষাব্যবস্থার নিচের স্তরমাত্র। ইসরায়েলের দাবি, এ ব্যবস্থা ৯০ শতাংশ সফল। এ ছাড়া ইসরায়েলের রয়েছে বারাক-৮, ডেভিডস স্লিং ও টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স (থাড) ব্যবস্থা, যেগুলো বিভিন্ন পাল্লার রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে সক্ষম। ‘
দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে ইসরায়েল ব্যবহার করে অ্যারো-২ ও অ্যারো-৩ ব্যবস্থা, যেমনটা বর্তমান ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে তেহরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে ব্যবহার করছে তেল আবিব। অ্যারো-২ ব্যবস্থাটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভেতর ও বাইরে উভয় ক্ষেত্রে খানিকটা উচ্চতার ক্ষেপণাস্ত্র থামাতে সক্ষম।
গত শনিবার ইসরায়েলি এক সেনা কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ সফল। তবে শতভাগ সাফল্য কোনো ব্যবস্থাতেই নেই। এর মানে কিছু ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ভেদ করতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েকটি সম্ভাব্য উপায়ে ইরানি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ভেদ করেছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সাধারণ কৌশল হলো, অতিরিক্ত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়ে ইসরায়েলের প্রতিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র শেষ করে ফেলা।
লন্ডনের কিংস কলেজের পোস্টডক্টরাল গবেষক মেরিনা মিরন আল-জাজিরাকে বলেন, ‘ইন্টারসেপ্টর (আক্রমণ প্রতিহতকারী ক্ষেপণাস্ত্র) যদি কমে যায়, তাহলে আর বেশিসংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করা যায় না। এ ছাড়া কোনো ব্যবস্থাই শতভাগ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকাতে পারে না।’
আল-জাজিরার বিশ্লেষক গ্যাটোপুলোস বলেন, ইরানের হাতে এখন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা উন্নত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থারই প্রত্যক্ষ ফলাফল। কারণ, কোনো আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ফাঁকি দেওয়ার একটি উপায় হলো, এমন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা, যা অতি দ্রুতগতিতে উড়ে আসে।
হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলোও রাডারে ধরা পড়লেও প্রতিহত করা কঠিন বলে জানান মিরন।
কিছু হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল (এইচজিভি) সংযুক্ত থাকে। এটি একটি যুদ্ধাস্ত্র, যা শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ দ্রুতগতিতে উড়তে ও দিক পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়। ইরানের ‘ফাত্তাহ-২’ ক্ষেপণাস্ত্রে এইচজিভি ব্যবহৃত হয়েছে। গ্যাটোপুলোস বলেন, ‘এটি দেখতে একটি সাধারণ ক্ষেপণাস্ত্রের মতো, যার শেষ প্রান্তে একটি উড়ন্ত যান যুক্ত থাকে।’
ইরানের অস্ত্রভান্ডারে আছে হোভেইজেহসহ বিভিন্ন ধরনের ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলায় এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রও ব্যবহার করেছে দেশটি। এগুলো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় কম উচ্চতায়, ধীরগতিতে উড়ে যায়; অনেকটা চালকবিহীন বিমানের মতো। এ কারণে এগুলো রাডারে ধরা কঠিন হয়।
কিংস কলেজ লন্ডনের গবেষক মারিনা মিরন জানান, ‘আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়ার আরেক কৌশল—দেখতে ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্রের মতো বস্তু পাঠিয়ে বা টোপ ফেলে প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ভারাক্রান্ত করা এবং এর মধ্য দিয়ে প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে ফেলা। রাডারে এসব বস্তু হুমকি হিসেবে ধরা পড়ে, কিন্তু বাস্তবে এগুলো হামলার জন্য পাঠানো নয়। সাধারণত এ ধরনের বস্তু ব্যবহার করা হয় প্রতিরোধী ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত খালি করার জন্য, যাতে পরে আসল ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনগুলো বাধাহীনভাবে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাতে পারে।’
মিরন আরও বলেন, কিছু ক্ষেপণাস্ত্র আবার রাডার ফাঁকি দেওয়ার প্রযুক্তিতে সজ্জিত। ফলে এগুলো প্রতিরক্ষাব্যবস্থার নজর এড়িয়ে যেতে পারে।