শিরোনামটা একটু অবাক করে দেওয়ার মতো, তাই না। ইরান এক সপ্তাহের মধ্যে পরমাণু বোমার অধিকারী হতে চলেছে–এই অভিযোগ তুলে গত শুক্রবার ২০০ যুদ্ধবিমান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইসরায়েল। অথচ তারাই কিনা ইরানকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশে পরিণত হতে সাহায্য করছে। আসলে বিষয়টি একটু অন্যরকম। কী করম–সেটা দেখা যাক।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম প্রভাবশালী বাস্তববাদী চিন্তাবিদ কেনেথ ওয়াল্টজ ২০১২ সালের ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে একটি নিবন্ধ লেখেন। এর শিরোনাম ছিল, ‘কেন ইরানকে বোমা পেতে দেওয়া উচিত’। বোমা মানে পারমাণবিক বোমা। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত ইরান মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল না করে বরং স্থিতিশীল করতে পারে।
তাঁর যুক্তি মূলত বাস্তববাদ এবং স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার প্রতিরোধের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। ওয়াল্টজের মতে: মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের একচেটিয়া পারমাণবিক আধিপত্য আঞ্চলিক অস্থিরতার কারণ। ইরান পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করলে ইসরায়েলের ক্ষমতায় তা একটা ভারসাম্য আনবে। যা একটি স্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করবে।
দ্বিতীয়ত, যখন উভয় প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকে, তখন পারস্পরিক ধ্বংসের যুক্তিসঙ্গত ভয় তাদের যুদ্ধ থেকে বিরত রাখে। ওয়াল্টজ যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ইসরায়েল ও ইরান উভয়েই পারমাণবিক শক্তিধর হলে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক পদক্ষেপ নিতে সতর্ক হবে। যেমনটা আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রে স্নায়ুযুদ্ধের সময় দেখা গিয়েছিল।
ওয়াল্টজ বিশ্বাস করতেন যে, রাষ্ট্রগুলো মূলত নিজেদের টিকে থাকার জন্য সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও ইরানের নেতারা কট্টরপন্থী আচরণ করেন, তবে তাঁরা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেবেন না। পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে ইরান আরও সতর্ক ও দায়িত্বশীল আচরণ করবে।
ওয়াল্টজের এই যুক্তিগুলো তখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। অনেকে তাঁর বিপক্ষে মত দেন এবং বলেন, এতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে।
ওয়াল্টজের তত্ত্ব অনুযায়ী, পারমাণবিক অস্ত্রই হলো চূড়ান্ত প্রতিরোধক। এবং নির্দিষ্ট শর্তাধীনে এর বিস্তার আসলে বৃহত্তর স্থিতিশীলতা বয়ে আনতে পারে। উত্তর কোরিয়ার কথাই ধরুন: পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পর থেকে তাদের আচরণ তর্কসাপেক্ষ হলেও অনেক হিসেবি এবং স্থিতাবস্থামুখী হয়ে উঠেছে। এটি ট্রাম্পকেও সে দেশের প্রধান কিম জং-উনের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে উৎসাহিত করেছিল।
ড. ম্যাথিউ মাভাক বৈশ্বিক ঝুঁকি, ভূ-রাজনীতি, কৌশলগত পূর্বাভাস, শাসনব্যবস্থা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলই একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, যা কৌশলগত ভারসাম্যহীনতা এবং চরম দায়মুক্তির জন্ম দিয়েছে। একটি প্রতিদ্বন্দ্বী পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের উত্থান হলে তা যুদ্ধংদেহী পক্ষগুলোকে আরও সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে বাধ্য করবে। সংঘাতগুলো সম্ভবত মুখরক্ষাকারী সুনির্দিষ্ট হামলায় সীমিত হয়ে পড়বে। যেমনটা কিছুদিন আগে পারমাণবিক শক্তিধর ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে দেখা গেছে। উগ্রবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দেওয়া সত্ত্বেও পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়ে পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত যৌক্তিক আচরণ করেছে।
ড. ম্যাথিউর মতে, একইভাবে, একটি পারমাণবিক শক্তিধর ইরান তার নিরাপত্তাকে প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধের ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে। এতে হামাস বা হিজবুল্লাহর প্রতি তার নির্ভরতা কমতে পারে।
তবে কিছু সমালোচক সতর্ক করেছেন যে, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তাহলে সৌদি আরব দ্রুত একই পথে যেতে পারে। এটি একটি বিতর্কিত বিষয়। বিশেষ করে যখন মনে রাখা হয় যে, ১৯৮০-এর দশকে সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময়, আমেরিকার নাকের ডগায় সৌদি আরব ইসলামাবাদের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিতে অর্থায়ন করেছিল!
আরও কিছু ধারাবাহিক প্রতিবেদন রয়েছে, যা থেকে জানা যায়, পাকিস্তানি পারমাণবিক প্রযুক্তির একাংশ ইতিমধ্যেই সৌদি আরবে চলে গেছে, যা পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন। আঞ্চলিক পারমাণবিক উত্তেজনা বাড়লে, রিয়াদ চাইলেই সেগুলো হস্তান্তরের অনুরোধ করতে পারে।
ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার ভয়কে সমর্থন করে না। যখন উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করেছিল, তখন দক্ষিণ কোরিয়া বা জাপান কেউই একই পথে এগোয়নি। প্রতিরোধ একবার প্রতিষ্ঠিত হলে সংঘাতে জড়ানোর আশঙ্কা কমে।
এ কারণে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইসরায়েলের পর আমেরিকা ও তার মিত্ররা যেভাবে ইরানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ভয় দেখাচ্ছে, তাতে তেহরানের সামনে কোনো বিকল্প নেই। রাশিয়া বা চীন সেভাবে ইরানের সমর্থনে মুখ খোলেনি। ফলে ইরানের জন্য একমাত্র বিকল্প হতে পারে পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক হওয়া। তাহলে ইসরায়েল, আমেরিকা বা তাদের মিত্ররা কথায় কথায় ইরানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে না।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে ওঠা ঠেকাতে একটি চুক্তি করতে চেয়েছিলেন। হয়তো তা সম্ভব ছিল। কিন্তু ইসরায়েল হামলা চালিয়ে আলোচনা ভেস্তে দিল। শুধু আলোচনাই ভেস্তে দিল না, ভবিষ্যতে হয়তো ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্রধর হয়ে উঠতে সাহায্য করল–কে বলতে পারে!