গত দুই দশক ধরে আমেরিকা ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের দিকে দীর্ঘ অগ্রযাত্রার গতি ধীর করার জন্য নিষেধাজ্ঞা, অন্তর্ঘাত, সাইবার হামলা এবং কূটনৈতিক আলোচনা–সবকিছুই ব্যবহার করেছে। কিন্তু গত রোববার ইরানের স্থানীয় সময় ভোররাত আড়াইটার দিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কঠোর সামরিক শক্তির প্রদর্শন দেখালেন, যা তাঁর পূর্ববর্তী চারজন প্রেসিডেন্ট ইচ্ছা করেই এড়িয়ে গিয়েছিলেন। কারণ এতে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকাকে যুদ্ধে ঠেলে দেওয়ার ভয় ছিল।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের হোয়াইট হাউস ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা ডেভিড ই. স্যাঙ্গার লিখেছেন, ট্রাম্প এই ঝুঁকি নিতে পারেন না যে তেহরানের মোল্লা ও জেনারেলরা, যারা ইসরায়েলের হামলা থেকে বেঁচে গেছেন, তারা পারমাণবিক অস্ত্রের চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছাবেন। তিনি বিশ্বের অর্ধেক পথ ঘুরে বি-২ বোমারু বিমানের একটি বহরকে নির্দেশ দেন ইরানের বিশাল পারমাণবিক কমপ্লেক্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রচলিত বোমা ফেলতে।
এর মূল লক্ষ্য ছিল ফোর্দোতে মাটির গভীরে থাকা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, যা ইসরায়েলের নাগালের বাইরে ছিল। ট্রাম্পের জন্য একটি শত্রু দেশের পারমাণবিক অবকাঠামোতে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত তার দ্বিতীয় মেয়াদের সবচেয়ে বড় এবং সম্ভাব্য সবচেয়ে বিপজ্জনক জুয়া।
ট্রাম্প বাজি ধরেছেন যে, তাঁর প্রশাসন ইরানের নেতৃত্ব এই অঞ্চলের ঘাঁটিগুলোতে ছড়িয়ে থাকা ৪০ হাজারেরও বেশি আমেরিকান সেনার বিরুদ্ধে যেকোনো প্রতিশোধমূলক হামলা প্রতিহত করতে পারবে। তিনি বাজি ধরেছেন, একটি খুবই দুর্বল ইরানকে তার পরিচিত কৌশলগুলো–যেমন সন্ত্রাসবাদ, জিম্মি করা এবং সাইবার হামলা– এসব প্রতিশোধ নেওয়া থেকে তিনি বিরত রাখতে পারবেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ট্রাম্প বাজি ধরেছেন যে, তিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পুনরায় শুরু করার সমস্ত সম্ভাবনা ধ্বংস করে দিয়েছেন। এটি একটি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য। ইরান স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, আক্রান্ত হলে তারা পরমাণু বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) থেকে বেরিয়ে আসবে এবং তাদের বিশাল কর্মসূচিকে ভূগর্ভে নিয়ে যাবে। সে কারণেই ট্রাম্প ফোর্দো ধ্বংস করার দিকে এত বেশি মনোযোগ দিয়েছিলেন। এই স্থাপনাটি ইরান ২০০৫ সালের দিকে গোপনে তৈরি করেছিল এবং ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তা ফাঁস করে দেন। সেখানেই ইরান প্রায় সব ধরনের বোমা বানানোর কাছাকাছি জ্বালানি উৎপাদন করছিল, যা আমেরিকা ও তার মিত্রদের সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন করেছিল।
গত শনিবার রাতে ট্রাম্পের সহকারীরা মিত্রদের বলছিলেন যে, ওয়াশিংটনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করা। তারা এই জটিল হামলাকে একটি সীমিত, নিয়ন্ত্রিত অভিযান হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা ২০১১ সালে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা বিশেষ অভিযানের অনুরূপ।
শনিবার একজন জ্যেষ্ঠ ইউরোপীয় কূটনীতিক নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ‘তারা (আমেরিকা) স্পষ্টভাবে বলেছে যে, এটি যুদ্ধের ঘোষণা ছিল না।’ একজন উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তার সাথে তার কথোপকথন বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি এটা বলেন। কিন্তু ওই ইউরোপীয় কূটনীতিক এটাও যোগ করেন যে, বিন লাদেন ৩ হাজার আমেরিকানকে হত্যা করেছিল। আর ইরান এখনো বোমাই তৈরি করেনি।
ট্রাম্প এই হুমকিও দিয়ে রেখেছেন, হয় শান্তি আসবে, নতুবা ইরানের জন্য এমন এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডি ঘটবে যা গত আট দিনে আমরা যা দেখেছি তার চেয়েও অনেক বেশি হবে। মনে রাখবেন, অনেক লক্ষ্য এখনো বাকি আছে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, যদি ইরান নতি স্বীকার না করে, তবে তিনি নির্ভুলভাবে তাদের ওপর আঘাত হানবেন।
মূলত, ট্রাম্প ইসরায়েলের সঙ্গে তাঁর সামরিক অংশীদারিত্বকে বাড়ানোর হুমকি দিচ্ছিলেন। ইসরায়েল গত আট দিন ধরে ইরানের শীর্ষ সামরিক ও পরমাণু বিজ্ঞানীকে সুচারূভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে তাঁদের বিছানায়, গবেষণাগারে এবং বাঙ্কারে হত্যা করেছে। আমেরিকা প্রাথমিকভাবে সেই অভিযান থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন রেখেছিল। ট্রাম্প প্রশাসনের সেই হামলা সম্পর্কিত প্রথম বিবৃতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জোর দিয়েছিলেন যে, ইসরায়েল ‘ইরানের বিরুদ্ধে একতরফা পদক্ষেপ’ নিয়েছে, এবং যোগ করেছিলেন যে আমেরিকা এর সাথে ‘জড়িত ছিল না।’
কিন্তু তারপর, ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইরানের ৮৬ বছর বয়সী সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে যখন খুশি হত্যা করার ক্ষমতা নিয়ে চিন্তার কথা প্রকাশ করেন। গত শনিবার রাতে তিনি স্পষ্ট করে দেন যে, আমেরিকা সম্পূর্ণরূপে জড়িত ছিল এবং রুবিওর বিবৃতির বিপরীতে দেশটি এখন গভীরভাবে ইরানের সাথে সংঘাতে ইসরায়েলের সাথে জড়িত।
এখন ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ক্ষমতাকে পিছিয়ে দিয়ে ট্রাম্প স্পষ্টতই আশা করছেন যে, তিনি দেশটির দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে পারবেন। আর সেটা হলো, আমেরিকান বি-২ বোমারু বিমানকে সামান্য প্রতিরোধ ছাড়াই ইরানের ভূখণ্ডের মধ্যে দিয়ে উড়ে যেতে এবং ফিরে আসতে পারছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর সন্ত্রাসী হামলায় এক হাজারেরও বেশি ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পর ইসরায়েলের নৃশংস প্রতিশোধে ইরান হঠাৎ করেই হামাস ও হিজবুল্লাহসহ তার প্রক্সি যুদ্ধের সঙ্গীদের হারিয়েছে। তাদের নিকটতম সিরিয়ার বাশার আল-আসাদকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। রাশিয়া ও চীন, যারা ইরানের সাথে একটি অংশীদারত্ব গঠন করেছিল, ইসরায়েলের হামলা পর তাদের কোথাও দেখা যায়নি।
ফলে শুধুমাত্র পারমাণবিক কর্মসূচিই ইরানের চূড়ান্ত ও একমাত্র আত্মরক্ষা ব্যবস্থা হিসাবে রয়ে গেছে। এটি সবসময়ই শুধু একটি বৈজ্ঞানিক প্রকল্প ছিল না। এটি ছিল পশ্চিমাদের প্রতিরোধের প্রতীক এবং নেতৃত্বের ক্ষমতা ধরে রাখার পরিকল্পনার মূল ভিত্তি।
মার্কিন কংগ্রেসে সমালোচকরা ইতিমধ্যেই ট্রাম্পের পদ্ধতির বিষয়ে প্রশ্ন তুলছিলেন। ভার্জিনিয়ার সিনেটর মার্ক ওয়ার্নার গোয়েন্দা কমিটির সদস্য ও শীর্ষ ডেমোক্র্যাট। তিনি বলেছেন, ট্রাম্প কংগ্রেসের সাথে পরামর্শ না করে, একটি পরিষ্কার কৌশল ছাড়াই, গোয়েন্দাদের ধারাবাহিক সিদ্ধান্তে কর্ণপাত না করে এ কাজ করেছেন, যেখানে ইরান বোমা তৈরির চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
যদি এমন পরিস্থিতিতে ইরান কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে অক্ষম হয়, যদি আয়াতুল্লাহর ক্ষমতা এখন দুর্বল হয়ে পড়ে, অথবা যদি দেশটি তার দীর্ঘদিনের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে, তাহলে কী হবে? ট্রাম্প নিঃসন্দেহে দাবি করবেন যে, একমাত্র তিনিই আমেরিকার সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে ইচ্ছুক ছিলেন এমন একটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য, যা তার পূর্ববর্তী চারজন প্রেসিডেন্ট খুব ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন।
কিন্তু আরেকটি আশঙ্কাও আছে। ইরান ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার করতে পারে, তার বেঁচে থাকা পারমাণবিক বিজ্ঞানীরা তাদের দক্ষতা ব্যবহার করে ভূগর্ভে যেতে পারেন এবং দেশটি উত্তর কোরিয়ার দেখানো পথ অনুসরণ করতে পারে তাহলে তারা পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমে যাবে। আজ কিছু গোয়েন্দা অনুমান অনুসারে উত্তর কোরিয়ার ৬০ বা তার বেশি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
ইরান হয়তো এই সিদ্ধান্তে আসতে পারে যে, বৃহত্তর শত্রু শক্তিগুলোকে দূরে রাখা এবং রোববার সকালে ইরানি আকাশে আরও অভিযান চালানো থেকে আমেরিকা ও ইসরায়েলকে বিরত রাখার একমাত্র পথ পারমাণবিক বোমার মালিক হওয়া।