ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার চলমান সংঘাত নাটকীয় মোড় নিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত যুদ্ধবিরতির মাঝেও। যদিও ট্রাম্প সম্ভাব্য এই যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে এক ধরনের কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে তুলে ধরেছেন, তবে বাস্তবতা বলছে, দুই পক্ষই এখন আসলে ‘শেষ মুহূর্তের খেলা’ খেলছে।
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ভোরে ইসরায়েল হামলা চালায় ইরানের রাজধানী তেহরানসহ বিভিন্ন স্থানে। ইরানি রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম প্রেস টিভি জানিয়েছে, এ হামলায় দেশটির পরমাণু বিজ্ঞানী সেদিঘি সাবের নিহত হয়েছেন। হামলার স্থান ছিল তেহরানের কেন্দ্রস্থল ফেরদৌসি ও ভালি আসরের প্রধান সড়কের কাছাকাছি—এটা কেবল একটি সামরিক অভিযান নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরির কৌশলও।
এই হামলার পাল্টা জবাব দিতে দেরি করেনি ইরান। ইসরায়েলে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে তারা। এতে এখন পর্যন্ত তিনজন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। হামলার পর ইসরায়েলে কয়েক দফায় সতর্কতামূলক সাইরেন বাজানো হয় এবং নাগরিকদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে বলা হয়।
এই অবস্থায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি এক টুইটবার্তায় স্পষ্টভাবে বলেন, ইসরায়েল যদি আগ্রাসন বন্ধ করে, তবে ইরানও হামলা বন্ধ করবে। তাঁর ভাষায়, ‘ইসরায়েল যদি ইরানের স্থানীয় সময় ভোর ৪টা থেকে তেহরানে হামলা না চালায়, তাহলে আমরাও কোনো জবাব দেব না।’ এই বার্তা দুইভাবে বিশ্লেষণ করা যায়—একটি হল শান্তি প্রস্তাব, অন্যটি হচ্ছে আত্মরক্ষামূলক শেষ হুঁশিয়ারি।’
গত ১৩ জুন ভোররাতে বিনা উসকানিতে ইরানে হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে ইসরায়েল ও এর বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্রসহ ড্রোন হামলার আশঙ্কা থেকে ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় আগাম প্রতিরোধমূলক হামলা চালানো হয়েছে।
ওই হামলা এখনো অব্যাহত রয়েছে। জবাবে ইসরায়েলে পাল্টা হামলা চালাচ্ছে ইরানও। এরমধ্যেই শনিবার ইসরায়েলের পক্ষ হয়ে ইরানে হামলা চালায় আমেরিকা। এর প্রতিক্রিয়ায় কাতার ও ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা করেছে ইরান।
এর পরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, ইরান ও ইসরায়েল সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। স্থানীয় সোমবার ‘ট্রুথ সোশ্যাল’ নামক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে তিনি এ ঘোষণা দেন। তবে ইরান জানিয়েছে, এখনো যুদ্ধবিরতি বা সামরিক অভিযান বন্ধের কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেছেন, যদি ইসরায়েল তাদের অবৈধ সামরিক আগ্রাসন বন্ধ করে, তবে তেহরানও প্রতিক্রিয়া জানানো থেকে বিরত থাকবে। তবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ বন্ধের বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে জানান তিনি।
যদিও যুদ্ধবিরতির ঘোষণা এসেছে, তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এ বিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেননি। এই নীরবতা ইসরায়েলের কৌশলগত দ্বিধা বা পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার প্রস্তুতির ইঙ্গিত হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ইসরায়েলি রাজনৈতিক বিশ্লেষক আকিভা এলদার বলেন, ‘এই যুদ্ধবিরতি সুখবর হলেও এটি একটি ইঙ্গিত। এখনও প্রতিটি পক্ষ চাইছে শেষ মুহূর্তে নিজেদের বিজয়ী হিসেবে দেখাতে।’ এলদার আরও বলেন, ‘আশা করি এটাই শেষ খেলা, অর্থাৎ চূড়ান্ত পর্ব। এটাই হয়তো সেই সুড়ঙ্গের শেষে দেখা যাওয়া আলো।’
এই বিশ্লেষকের মতে, এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। গাজায় হামাসের সঙ্গে বা লেবাননে হিজবুল্লাহর সঙ্গেও একই প্যাটার্নে যুদ্ধবিরতি এসেছিল—যেখানে চূড়ান্ত মুহূর্ত পর্যন্ত একে অপরকে ছাড় না দিয়ে শেষ পর্যন্ত সামরিক ও মনস্তাত্ত্বিক ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা চলে। এলদার বলেন, ‘শেষ পরিস্থিতিতে দুই পক্ষি বোঝাতে চাইছে—আমরা পিছিয়ে নেই, বরং আমরা আরও ভালোভাবে সক্ষম।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুদ্ধবিরতির কূটনৈতিক ঘোষণার পরও যুদ্ধ যখন বাস্তবিক ময়দানে বজায় থাকে, তখন সেটা কোনো পক্ষের আত্মসমর্পণ নয়—বরং একে বলা যায় মর্যাদা রক্ষার প্রতিযোগিতা। ফলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুদ্ধবিরতি একটি কৌশলগত বিরতি হলেও, এটি যুদ্ধের সমাপ্তি নির্দেশ করে না।
এই পরিস্থিতিতে পুরো অঞ্চল উদ্বেগে, বিশ্ব রাজনৈতিক মঞ্চে চলছে হিসাব-নিকাশ। শেষ পর্যন্ত এই ‘শেষ খেলা’য় কে কৌশলে জয়ী হয়, তা সময়ই বলে দেবে।