গত ১১–১২ দিনের বিধ্বংসী যুদ্ধ। শুরু হয়েছিল ইরানে ইসরায়েলের হামলার মাধ্যমে। পরে জড়াল আমেরিকা। এই যুদ্ধের কারণ ‘ইরান পরমাণু বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে’। অভিযোগটা নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের, যা ডাহা মিথ্যা। তারপরেও স্বল্প সময়ের এই যুদ্ধে মানবজাতি দেখল, এক প্রবল ধ্বংসলীলা। শত শত মৃত্যু, একের পর এক বহুতল ভবনের গুড়িয়ে যাওয়া। বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের মহিমা কীর্তন। এক আমেরিকার বি-টু স্টেলথ বোমারু বিমান শৌর্য বা ধ্বংসলীলা চালানোর ক্ষমতা যেভাবে মূলধারার সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষকে গিলিয়েছে তাতে মানবসন্তানের জন্য অন্য কোনো শত্রুর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের এই খেলায় আত্মসংহারের এমন নির্লজ্জ প্রদর্শনী বোধহয় সামান্য কয়েকজন অতি নির্বোধের পক্ষে চালান সম্ভব।
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পরাশক্তি আমেরিকার মহামহিম প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, যুদ্ধ থামছে। স্থায়ী যুদ্ধ বিরতিতে রাজি আমেরিকা, ইসরায়েল ও ইরান। এ ব্যাপারে আমেরিকা ও ইসরায়েলের সম্মতি পাওয়া গেলেও ইরান সরকারিভাবে কোনো যুদ্ধবিরতির কথা বলেনি। তবে বলবে বলেই ধরে নেওয়া যায়। তাহলে আসলে যুদ্ধের অর্জন কী? জয়? কার? ইরান, আমেরিকা না ইসরায়েলের?
আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পরমাণু বোমার বাস্তব পরীক্ষা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানি অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেমন হবে? তিনি বলেছিলেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেমন হবে জানি না। তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ মানুষ ইট-পাটকেল আর লাঠি-সোটা নিয়ে লড়বে। সেদিক দিয়ে অবশ্য গোটা মানবজাতির নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে আপাতত রেহাই মিলেছে–এটাই কি স্বস্তির!
এ বিষয়ে নিউইয়র্ক টাইমসে একটি বিশ্লেষণ লিখেছেন ফারনাজ ফাসিহি। তিনি পত্রিকাটির জাতিসংঘের ব্যুরো প্রধান। ফলে গোটা বিশ্বের খবরা-খবর রাখেন। তিনি বলেছেন, কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার আগেও ইরান একটি পথ খুঁজছিল। গত সোমবার সকালে ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল আমেরিকার বিরুদ্ধে পাল্টা হামলার বিষয়ে আলোচনার জন্য একটি জরুরি বৈঠক করে। কারণ গত শুক্রবার আমেরিকানরা ইরানের তিনটি প্রধান পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা করে। যা ইরানের সামরিক নেতৃত্ব এবং অবকাঠামোর জন্য মারাত্মক ক্ষতি ছিল।
ইরানের মুখ রক্ষা করা দরকার ছিল। তাই দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি পাল্টা হামলার নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আয়াতুল্লাহ নির্দেশ দিয়েছিলেন, হামলাগুলো যেন সীমাবদ্ধ থাকে। আমেরিকার সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়াতে চেয়েছিল ইরান।
তাই ইরানের বিপ্লবী গার্ডস কর্পস কাতারে অবস্থিত মার্কিন বিমান ঘাঁটি বেছে নেয়। এর পেছনে দুটি কারণ। এক. এটি এ অঞ্চলের বৃহত্তম আমেরিকান সামরিক ঘাঁটি। দুই. এই ঘাঁটিটি সপ্তাহান্তে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আমেরিকান বি-টু বোমারু বিমানের হামলার সমন্বয়ে জড়িত ছিল। কিন্তু কাতার ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় ইরানি কর্মকর্তারা হামলা সীমিত রাখতে চেয়েছিলেন। সে কারণে হামলার কয়েক ঘন্টা আগে, ইরান মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে একটি হামলা আসন্ন বলে আগাম নোটিশ পাঠাতে শুরু করে। কাতার তার আকাশসীমা বন্ধ করে দেয় এবং আমেরিকানদের সতর্ক করা হয়।
তবে চার ইরানি কর্মকর্তা নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ইরানের নেতারা আশা করছিলেন যে তাদের সীমিত হামলা এবং আগাম সতর্কতা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে থামিয়ে দিতে রাজি করবে। ফলে ইরানও একই কাজ করতে পারবে।
তারা আরও আশা করেছিল যে ওয়াশিংটন ইসরায়েলকে ইরানের ওপর তার ব্যাপক বিমান হামলা বন্ধ করার জন্য চাপ দেবে, যা ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলিতে আমেরিকান হামলার অনেক আগে শুরু হয়েছিল এবং সোমবার রাতেও চলমান ছিল। বাস্তবে কিন্তু তাই হয়েছে। ইরানের এই কৌশলের কারণে দোহায় হামলার পরপরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, আমাদেরকে আগাম নোটিশ দেওয়ার জন্য ইরান ধন্যবাদ। এরফলে কোনো হতাহত হয়নি। এর পরপরই ট্রাম্প ঘোষণা করেন, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি আসন্ন। পরের কয়েক ঘন্টার মধ্যে, উভয় দেশ নিশ্চিত করে যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরান ডেস্কের পরিচালক আলী ভায়েজ বলেছেন, প্রতিটি পক্ষ এখন বিজয়ের একটি আখ্যান তৈরি করতে পেরেছে। একই সাথে অঞ্চল এবং তার বাইরের জন্য গুরুতর পরিণতিসহ একটি বৃহত্তর সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি এড়াতে পেরেছে।
আলী ভায়েজ আরও বলেন, আমেরিকা বলতে পারে যে তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে পিছিয়ে দিয়েছে। ইসরায়েল বলতে পারে যে একটি আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ তারা ইরানকে দুর্বল করেছে। আর ইরান বলতে পারে যে, তারা টিকে আছে এবং অনেক শক্তিশালী সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
ইরান বা ইসরায়েল এরপর কী করবে তা এখনো লাখ টাকার প্রশ্ন। যদিও এই অঞ্চলে আমেরিকান বাহিনীর উপর ইরানের সীমিত আক্রমণ একটি গভীর সংঘাত এড়াতে হিসাব করে করা হয়েছিল। তবে এর মানে এই নয় যে শত্রুতা শেষ হয়ে গেছে।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আমেরিকান হামলা সত্ত্বেও, তারা ইরানের ইউরেনিয়ামের মজুদের কী হয়েছে তা নিশ্চিত নন। ইরানের কি ইউরেনিয়াম আরও সমৃদ্ধ করার ক্ষমতা আছে? এই সংঘাতে পর ইরানসহ অনেক দেশই ভাবতে পারে পরাশক্তির দাপট ও নৃশংসতা থেকে বাঁচতে পরমাণু বোমা এবং দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রই একমাত্র বর্ম।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি নিজ দেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। এটাই হয়তো ইরানের সান্তনা। অন্যদিকে ইসরায়েলে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সামনে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। যুদ্ধ চালিয়ে গিয়ে দেশের ভেতরে-বাইরে তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পারতেন না। ফলে তিনিও হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। আর মহামহিম ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেওয়ার পর ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত দিয়ে হয়তো নোবেলের আরও কাছে পৌঁছালেন।
তাহলে এই লড়াইয়ে কী সব পক্ষ জিতল? আর হারল মানুষ?