ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ উপ-নির্বাচনের কয়েকটি কেন্দ্রে ভোটে অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনের চলমান তদন্তকে স্বাগত জানিয়েছেন জয়ী আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী অধ্যক্ষ ড. শাহজাহান আলম সাজু। তিনি বলেন, স্মরণকালে এমন ভালো নির্বাচন হয়নি। এই উপনির্বাচনে মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ ছিল।
এই তদন্তের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছেন অধ্যক্ষ সাজুর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী (কলারছড়ি প্রতীক) অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা। তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগীয় তদন্ত অথবা নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর আমি একটি আবেদন করেছি।’ আজই নির্বাচন কমিশনে এ আবেদনপত্র পৌঁছানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ আসনের উপনির্বাচনে গত ৫ নভেম্বরের ভোটে ৪টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণে অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত আজ বুধবার শুরু হয়েছে। বেলা ১১টায় আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. রুহুল আমিন তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেন। এছাড়া জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে তদন্ত করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনকে বলেন, ‘অনিয়ম হলে ভোটের দিনই অন্য প্রার্থীরা অভিযোগ করতেন। তারা তো সেটি করেননি। আমি নিজেও জানি না আসলে কি হয়েছে- না হয়েছে সেখানে। তবে এটি বলব- স্মরণকালে এমন নির্বাচন হয়নি। এতে মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ ছিল। ভোটের দিন পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেছেন। বিভিন্ন সংস্থার লোকজন ছিল। আমার ৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন– তারাও তো কেউ এমন বলেননি বা অভিযোগ করেননি যে, কেন্দ্রগুলোতে সমস্যা হয়েছে। তাছাড়া এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে আমার নিজেরও জানা নেই।’
তদন্তকে স্বাগত জানিয়ে সাজু বলেন, ‘তদন্ত হচ্ছে ভালো। আমি একে স্বাগত জানাই। তারা দেখুক তদন্ত করে– আসলে কোনো কিছু ঘটেছে কিনা। এরকম অভিযোগ তো আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর (জিয়াউল হক মৃধা) ক্ষেত্রেও আছে। উনার এখানে (সরাইল উপজেলা) তো অনেক কেন্দ্রে আমি দেখলাম আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৯০/৯৫ ভোট। উনি পেয়েছেন ১২/১৩’শ ভোট। সরাইলের নোয়াগাঁও, কালীকচ্ছ কেন্দ্রে এমন হয়েছে। আমিতো এ নিয়ে অভিযোগ করতে যাইনি। তদন্তকে আমি খারাপ কিছু মনে করি না। যেহেতু কোনো প্রার্থী অভিযোগ করেনি যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। তারপরও তারা কোনো সোর্সের মাধ্যমে খবর পেয়ে এটি করে থাকলেও আমি স্বাগত জানাই।’
স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জাতীয় পার্টির সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির আহ্বায়ক (রওশনপন্থী) জিয়াউল হক মৃধা নির্বাচন কমিশনের তদন্তে তাঁর আস্থা নেই বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কমিশন তাদের কথা রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আমি সরল মানুষ, আমি মানুষকে বিশ্বাস করি। কিন্তু এই ক্ষেত্রে দেখলাম বিশ্বাস বাবুর মৃত্যু হয়েছে। বিশ্বাস বাবু আর বেঁচে নেই।‘
এর আগে মহাজোটে প্রার্থী হিসেবে এই আসন থেকে দুবার জয়ী জিয়াউল হক মৃধা ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনকে বলেন, ‘নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত অথবা নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর আমি একটু আবেদন করেছি।‘
প্রসঙ্গত, ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ সংসদীয় আসনটি জেলার সরাইল ও আশুগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত। আওয়ামী লীগের শাহজাহান আলম সাজুর বাড়ি আশুগঞ্জ ও জিয়াউল হক মৃধার বাড়ি সরাইল উপজেলায়। এই উপ–নির্বাচনে আশুগঞ্জ উপজেলার চারটি কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
আশুগঞ্জ ইউএনওর কার্যালয়ে জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. রুহুল আমিন তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেন। এছাড়া জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নাল আবেদীন এই তদন্ত করছেন।
দিনভর বড়তল্লা, তালশহর পশ্চিম ও যাত্রাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং নূরানীয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রের ৪ প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, ২৮ সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ও ৪৬ জন পোলিং অফিসার ছাড়াও কেন্দ্রে কর্তব্যরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা, পুলিশ এবং আনসার সদস্যদের বক্তব্য শুনেন তদন্ত কর্মকর্তা। এর আগে নির্বাচনে ওইসব কেন্দ্রে দায়িত্বপালনকারী সবাইকে ফোনকল করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে আনা হয়।
তদন্ত কমিটিকে ৩ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন পরিচালনা-২ অধিশাখার উপ-সচিব মো. আতিয়ার রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসককে গণমাধ্যমে আসা ভোটে অনিয়মের খবরের বিষয়ে তদন্ত করে ৩ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। এরপ্রেক্ষিতে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলম অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. রুহুল আমিনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন।
তদন্ত কমিটির কাছে আসা ফিরোজ মিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষক মো. তোফায়েল আজম বলেন, আমি তালশহর পশ্চিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করি। আমার কেন্দ্রে অত্যন্ত সুন্দর-সুষ্ঠুভাবে ভোট সম্পন্ন হয়। এখানে কলারছড়ি প্রতীকের প্রার্থী পেয়েছেন ২৫৫ ভোট আর নৌকার প্রার্থী পেয়েছেন ৩১২ ভোট।
যাত্রাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শিরিনা হক। ওই কেন্দ্রেও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
যাত্রাপুর নূরানীয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনকারী সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার রাধেশ চন্দ্রও তাঁর বুথে কোনো অনিয়ম হয়নি বলে জানান। তল্লা কেন্দ্রে দায়িত্বপালনকারী হাসিবুর রহমান জানান, কোনো অনিয়ম হয়েছে তা মনে হয় না।
তালশহর পশ্চিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের মোট ভোট ২১৫০। এরমধ্যে কাস্ট হয় ৫৮২ ভোট। যাতে কলারছড়ি পেয়েছে ২৫৫ আর নৌকা ৩১২ ভোট। যাত্রাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভোটার সংখ্যা ৩৪৬০। এখানে নৌকা পেয়েছে ২১৪৫ আর কলারছড়ি ১২৮ ভোট। যাত্রাপুর নূরানীয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রের মোট ভোট ৩২১০। এরমধ্যে নৌকা পেয়েছে ১৭১৬ ভোট। কলারছড়ি ৬৬। বড়তল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ৪৯৩৯ ভোটের মধ্যে কাস্ট হয় ৩৩৬৪ ভোট। এরমধ্যে নৌকা পেয়েছে ৩৩২৮ ভোট। আর কলারছড়ি পেয়েছে ২৪ ভোট।
উল্লেখ্য, বড়তল্লায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাজুর বাড়ি। আর তার ভোট কেন্দ্র যাত্রাপুর নূরানীয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা। সেই হিসেবে যাত্রাপুর ও বড়তল্লা কেন্দ্র তাঁর নিজের এলাকাধীন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু ৬৬ হাজার ৩১৪ ভোট পেয়ে জয়ী হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক মৃধা পেয়েছেন ৩৭ হাজার ৫৫৭ ভোট। ২৮ হাজার ৭৫৭ ভোট বেশি পেয়ে জয়ী হন সাজু।