নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার তমরদ্দি লঞ্চঘাট বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) থেকে একজনকে এবং জেলা পরিষদ থেকে অন্যজনকে ইজারা দেওয়া হয়েছে। ওই ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিএনপির দুইপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ, হামলা-মামলার ঘটনা ঘটছে।
এ ঘটনায় বিএনপির এক পক্ষ অপর পক্ষকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও হাতিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) মোহাম্মদ আলীর দোসর বলে অভিযুক্ত করে আসছে। এসব কারণে উপজেলা ও ইউনিয়ন বিএনপির দুই নেতাকে দলীয় পদ পদবী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এসব জটিলতা নিরসনে হিমশিম খাচ্ছে উপজেলা প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, বিআইডব্লিউটিএ ৩৬ লাখ ৭১ হাজার ৫০০ টাকায় তমরদ্দি লঞ্চঘাট (ঘাট-পয়েন্ট/খাল-টোল স্টেশন) হাতিয়ার সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর ঘনিষ্ঠজন, আওয়ামী লীগের সদস্য গোলাম মাওলা কাজলের সাথে ইজারা চুক্তি সম্পাদন করে। কিন্তু ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কাজলের অধীনে ঘাটে মালমাল লোড-আনলোডে নিয়োজিত শ্রমিকরা চলে যান। এরপর ৭ আগস্ট থেকে ঘাটের এ অচলাবস্থা কাটাতে শ্রমিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা মালমাল লোড-আনলোডের দায়িত্ব নেন।
পরবর্তীতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ ও যাত্রী হয়রানি বন্ধ করার শর্তে সেপ্টেম্বর মাসে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে হাতিয়া উপজেলা ইবতেদায়ী মাদ্রাসার সভাপতি ইয়াকুব আলী এক মাস ঘাট পরিচালনা করেন। এরপর থেকে ইজারাদার গোলাম মাওলা কাজলের ভগ্নিপতি জাফর উল্লা মিলাদ শ্রমিক প্রতিনিধিদের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে ঘাটে মালামাল লোড-আনলোডের দায়িত্ব নেন। তিনি ৯৫ জন শ্রমিক দিয়ে মালামাল লোড-আনলোডের মাধ্যমে আয়ের টাকার অংশ শ্রমিকদের দিয়ে বাকিটা ইজারাদারকে দেন।
তবে, এ প্রক্রিয়ায় ইজারাদার মাওলা কাজলের সাথে আতাতের মাধ্যমে উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক মো. আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধে ঘাট নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ তোলেন তমরদ্দি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি তারভীর হায়দার তান্নার অনুসারীরা।
এদিকে, গত ১ সেপ্টেম্বর একই ঘাট একই অর্থ বছরের জন্য নোয়াখালী জেলা পরিষদ থেকে ৬ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৫ টাকা মূল্যে তারভীর হায়দার তান্নার অনুসারী বিএনপি নেতা বেলাল হোসেনকে ইজারা দেওয়া হয়।
এরপর থেকে তারভীরের অনুসারীরা ঘাটে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। এনিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। যার জেরে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ঘটে। এ সময় নারীসহ অন্তত ১০ জন আহত হয় এবং ঘাটের পাশে শ্রমিক দলের কার্যালয় এবং শ্রমিকদের বাড়িঘরে হামলা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে পুলিশ ও নৌ বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
এ ঘটনায় গত ১ মার্চ কামরুল ইসলাম নামে শ্রমিক দলের এক কর্মী বাদী হয়ে তানভীর হায়দার তান্নাসহ ৩০ জনের নাম উল্লেখ ছাড়াও অজ্ঞাত আরও ১৫/২০ জনকে আসামি করে হাতিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন।
পরদিন আকলিমা বেগম নামে এক নারী ঘাটে মালামালের অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করায় তাঁকে ও তাঁর বোন নাসিমা বেগমকে পিটিয়ে আহত করার অভিযোগে আলমগীর কবির ও গোলাম মাওলা কাজলসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে থানায় পাল্টা একটি মামলা দায়ের করেন।
এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে তমরদ্দি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি তানভীর হায়দার তান্না এবং যুগ্ম সম্পাদক আলমগীর কবিরকে দলের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পদবী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে আলমগীর কবির বলেন, ‘হাতিয়ার বাসিন্দা নন বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির এমন এক নেতা আমাকে হাতিয়ায় তাঁর পক্ষে কাজ করার প্রস্তাব দেন। তাঁর প্রস্তাবে আমি রাজি না হওয়ায় তিনি প্রতিহিংসা থেকে জেলা কমিটিকে দিয়ে আমাকে শোকজ লেটার পাঠান। শোকজ লেটারের জবাব দেওয়ার পরও আমাকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অথচ আমার প্রতিপক্ষ আমাকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে বলে প্রচার করছে। আমাকে রাজনৈতিকভাবে হেয় করার উদ্দেশ্যে তারা আমার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন বিভিন্ন অভিযোগ তুলছে। তাদেরই চক্রান্তে আমাকে জড়িয়ে কিছু মিডিয়া মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করে। আমি এসব মিথ্যা অভিযোগ ও সংবাদের প্রতিবাদ এবং নিন্দা জানাচ্ছি।’
আওয়ামী লীগের গোলাম মাওলা কাজলের সাথে আতাতের অভিযোগের বিষয়ে আলমগীর হোসেন বলেন, ‘কাজলের ইজারা বাতিলের জন্য আমি নিজে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করেছি, কিন্তু চলতি বছরের জুন পর্যন্ত তাঁর ইজারার মেয়াদ থাকায় ইজারাটি বাতিল করা হয়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইজারাদারের ভগ্নিপতি জাফর উল্লা মিলাদের মাধ্যমে ঘাটে মালামাল লোড-আনলোডের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এতে আমার কোনো প্রকার সংশ্লিষ্টতা নেই।’
এ বিষয়ে তানভীর হায়দার তান্না বলেন, ‘মূলত তমরদ্দি লঞ্চঘাটের ইজারাদার দুইজন। আওয়ামী লীগের গোলাম মাওলা কাজলকে বিআইডব্লিউটিএ থেকে এবং বিএনপির বেলাল উদ্দিনকে জেলা পরিষদ থেকে ঘাট ইজারা দেওয়া হয়েছে। যার কারণে ঘাট পরিচালনা নিয়ে তাদের দুই পক্ষের মধ্যে মরামারির ঘটনা ঘটে। এর সাথে আমার কোনো সম্পৃক্তাতা নেই। এমনকি গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ঘাটে হামলার দিন আমি ঢাকায় ছিলাম। এরপরও পরিকল্পিতভাবে আমাকে এর সাথে জড়ানোর চেষ্টা করে প্রতিপক্ষ।’
দলীয় পদ থেকে অব্যাহতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জেলা থেকে পাঠানো কোনো অব্যাহতিপত্র আমি এখনো পায়নি। এমনকি আমাকে কোনো প্রকার কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়নি। অথচ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে প্রচার করা হয়। কোনো প্রকার কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়া এবং আমার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ তা আমাকে না জানিয়ে অব্যাহতি দেওয়ার ইখতিয়ার জেলা কমিটির নেই। এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে দলের ক্ষতি হবে তাই নীরব আছি।’
এ বিষয়ে নোয়াখালী জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মো. হারুনুর রশিদ আজাদ বলেন, ‘আইন শৃঙ্খরা পরিস্থিতি দেখার দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর। তবে, কোনো প্রকার দখলের সাথে আমারে দলের কারো সম্পৃক্ততার অভিযোগ পেলে এবং অভিযোগ আমাদের তদন্তে প্রমাণিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও এ ধারা চলমান থাকবে।’
ঘাট দখল নিয়ে সংঘর্ষ ও মামলার বিষয়ে হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একেএম আজমল হুদা বলেন, ‘দুটি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্ত করে এ বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তবে, লঞ্চঘাটে নতুন করে যেন কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) কাজী শামীম বলেন, ‘তমরদ্দি ঘাট সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে গত ৫ মার্চ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে বিআইডব্লিউটিএ এবং জেলা পরিষদের প্রতিনিধিসহ বিরোধ সংশ্লিষ্ট উভয় পক্ষকে নিয়ে সভা করা হয়েছে।’
সভায় বিআইডব্লিউটিএ এর ইজারাদার ও জেলা পরিষদের ইজারাদারের প্রতিনিধিরা একমত পোষণ না করায় তাদের উভয় পক্ষকে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত বা পরবর্তী নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করা এবং আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয় এমন কোনো কাজ না করার জন্য অনুরোধ করে সভা শেষ করা হয়।
বর্তামানে ঘাটটি বিআইডব্লিউটিএ এর ইজারাদারের প্রতিনিধির দখলে থাকায় এবং তা জেলা পরিষদের খাস আদায়কারীর প্রতিনিধি নিজের দখলে নেওয়া চেষ্টা করায় উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটছে। এতে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।