দেশজুড়ে তীব্র তাপপ্রবাহেও থেমে নেই নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের কাজ। তবে কঠিন পরিশ্রমের পরেও ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা শ্রমিকেরা। দেশের ৪১টি শ্রমখাতের ২৪টিতেই গত ৬ থেকে ৩২ বছরে নূন্যতম মজুরি বাড়েনি বলে দাবি করেছে গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতে নীতিমালা ও আইন করায় জোর দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে শিগগিরই শ্রম আইনে পরিবর্তন আনা হবে বলে জানান শ্রম প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম চৌধুরী।
সারাদেশের ওপর দিয়েই বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপদাহ। এই তপ্ত রোদেই কাজ করে যাচ্ছেন নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতের শ্রমিকেরা। তাদের বেশিরভাগেরই দৈনিক মজুরি ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করলেও মূল্যাস্ফীতির চাপে এই মজুরিতে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন তারা।
এক নির্মাণ শ্রমিক বলেন, ‘এক কাপ চা আগে ছিল ৫ টাকা, এখন হয়েছে ১০ টাকা। দিনে আমাদের কাজ করতে হয় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এরপরেও অনেক সময় আবার ওভার টাইম করতে হয় রাত ১০টা পর্যন্ত। আমাদের বেতনগুলো যদি একটু উন্নত করা হতো, তাহলে খুব ভালো হতো।’
দেশে মূল্যস্ফীতি এখন ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। বিলসের এক গবেষণা বলছে, প্রায় ৬০ শতাংশ খাতে গত ৬ থেকে ৩২ বছরেও মজুরি বাড়েনি। পেট্রোল পাম্পের শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি গত ৩২ বছরেও পুনঃবিবেচনা হয়নি। এই খাতে শ্রমিকদের নূন্যতম মাসিক মজুরি মাত্র ৮০০ টাকা। আয়ুর্বেদিক কারখানায় মজুরি ৪ হাজারের কিছু বেশি। জুতার কারাখানা ও সিনেমা হলের শ্রমিকদের নূন্যতম মুজরিও অনেক কম।
বিলসের গবেষণা বলছে, সরকারির তুলনায় বেসরকারি খাতের শ্রমিকদের মজুরি ২৯ থেকে ৯৬ শতাংশ কম। আর ঢাকার তুলনায় গ্রামের শ্রমিকদের মজুরি অনেক কম। সব খাতের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে নীতিমালা ও আইন প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিলসের নির্বাহী পরিচালক সুলতান আহমেদ বলেন, ‘আমরা এখন এলডিসি গ্রাজুয়েশনে যাচ্ছি। আমরা উন্নয়নের এত বড় মাপকাঠি দেখাচ্ছি। আমরা পার ক্যাপিটা ইনকামের বৃদ্ধি দেখাচ্ছি। কিন্তু সে হিসেবে মজুরি আমাদের এখানে কোনোদিনও নির্ধারিত হয়নি। আইন তৈরি হওয়া উচিত যে এর নিচে বাংলাদেশে কেউ কোথাও মজুরি দিতে পারবে না।’
এই গবেষক আরও বলেন, ‘এদেশে সার্বজনিন মজুরী নির্ধারণের কোনো মানদন্ড নেই। যেটি বেড়েছে সেটি কয়েকটি সেক্টরে। যেমন বেশি প্রচার হয় তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে। আর ন্যায্য দাবি তুলে ধরতে গিয়ে অনেককেই জীবন দিতে হয়। তবে সব ধরণের শ্রমিকদের কথায় বিবেচনায় দেশে মজুরী নির্ধারণের কোনো মানদন্ড নেই। এখনো ঠিকাদারদের সাথে দর কষাকষিও হয়না, কারণ ইউনিয়ন নেই। এটি হচ্ছে মূল সংকট। একটি দেশ ৫০ বছর আগে স্বাধীন হয়ে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। যেখানে উন্নয়নের মাপকাঠি নির্মাণ সেখানে মজুরী নির্ধারণ নেই। তাদের মজুরীর একটি স্কেল থাকলেও সেটি বড় বড় ডেভেলপার দিচ্ছে। আবার গৃহশ্রমিকরাও শ্রমিক, এদেরও আলোচনার ভিত্তিতে মজুরী দেওয়া হয়।’
সুলতান আহমেদ বলেন, ‘নূন্যতম মজুরী নির্ধারণের একটি নীতিমালা ও আইন হওয়া উচিত। যে এর নিচে দেশের কোথাও মজুরী দিতে পারবে না। আবার কর্মঘন্টা যে কত ঘন্টা কাজের জন্য কত মজুরি। একটি পরিবারের মর্যাদাকর জীবন যাপনের নূন্যতম যে প্রয়োজন সে প্রয়োজন মেটানোর জন্য। আবার অনেক শ্রমিকদের প্রতিদিন কাজ থাকে না, যেমন বৃষ্টি দিন। এদের সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনতে হবে। একজন শ্রমিকের কাজ না থাকলে সে যাতে সহযোগিতা পায়। আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে শ্রমিকদের জন্য কোনো কর্মসূচি নেই।’
শ্রমিকদের কল্যানে দ্রুত শ্রম আইনে পরিবর্তন আনা হচ্ছেন বলে জানালেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম চৌধুরী। আইন সংস্কারে আইএলওসহ শ্রমিক ও মালিকদের সাথে আলোচনা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘শ্রমিকদের কল্যানে কাজ করতে পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। দেশে–বিদেশে যে আনস্কিলড শ্রমিকরা আছেন, তারা যথাযথ মজুরি পান না। বিদেশে অন্যান্য দেশের তুলনায় তারা অর্ধেক মজুরি পায়, এতে আমাদের দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের রেমিটেন্স প্রবাহও কমে যায়। শ্রমিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা যদি এই অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রতিটি শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্কিলড করে বিদেশে পাঠাতে পারি, তাহলে শ্রমিক ও দেশ দুটিই উপকৃত হবে। শ্রমিক–মালিকদের সমস্যাও সমাধান করা হচ্ছে। শ্রমের জন্য অধিদপ্তর থাকলেও কর্মসংস্থানের অধিদপ্তর নেই। এই অধিদপ্তর হওয়ার পর প্রতি জেলায় ও উপজেলায় আরও ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম করা হবে। একটি শ্রমিকও বিদেশে যাতে আনস্কিল্ড না যায়, সে বিষয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে। শ্রম আইনে পরিবর্তন করা হবে। নেক্সট সেশনে এই আইনটি পাস করা হবে। আইএলও কিছু সাজেশন দিয়েছে, শ্রমিক ও মালিকদের সাজেশন নিয়ে এই আইন করা হচ্ছে। একটি গ্রহণযোগ্য আইন খুব দ্রুতই করা হবে।’
কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলেও জানান শ্রম প্রতিমন্ত্রী।