আহমেদ রুবেলের মৃত্যুর পরেও ‘পেয়ারার সুবাস’—এর প্রিমিয়ার শো চলছে। এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। কারণ শো মাস্ট গো অন। আহমেদ রুবেল মৃত্যুর পরে কথা বলতে পারলে, উনিও হয়তো একই সুরে সুর মেলাতেন। কারণ উনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন শিল্পী। শুধু নামে নয়, কাজেও।
পেয়ারার সুবাস ছড়াবে আর মাত্র দুই দিন পরেই দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে। যে সিনেমার জন্য ছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষা সবার। কয়েক মাস আগে ‘প্রিয় সত্যজিৎ’ সিনেমার প্রিমিয়ারের একদিন আগে নির্দেশক প্রসূন রহমান এবং মূখ্য অভিনেতা আহমেদ রুবেল এসেছিলেন ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের সেটে, ডিজিটাল বিভাগের আমন্ত্রণে। আমার ঘাড়ে পড়েছিল ‘আই ভিউ’ নামের অনুষ্ঠানটির সমন্বয় এবং সাক্ষাৎকার গ্রহণের দায়িত্ব। এর আগে কেউ কেউ বলেছিলেন, আহমেদ রুবেল কিছুটা খামখেয়ালি মানুষ। তাঁকে সেটে আনা নিয়েও কেউ কেউ সংশয়ে ছিলেন।
‘প্রিয় সত্যজিৎ’ নির্মাতা প্রসূন রহমানের কাছ থেকে রুবেল ভাইয়ের ফোন নাম্বার নিয়ে কল দিতেই শোনা গেল ওনার ভরাট কন্ঠস্বর! এরপর এই সাক্ষাৎকারের জন্য যতবার ওনাকে কল করেছি, প্রত্যেকটা কল উনি ধরেছেন। ধরতে না পারলে কল ব্যাক করেছেন এবং নির্ধারিত সময়ে চলেও এসেছেন সেটে। অনুষ্ঠান শুরুর আগে আমি অলিখিত নিয়মে শিল্পী-নির্মাতার সাথে ক্যান্টিনে ও মেকাপ রুমে আড্ডা দিতে থাকি। রুবেল ভাই ও প্রসূন রহমান সেটে যাওয়ার আগে নানা বিষয়ে ঘুরেফিরে আলাপচারিতা তাই চলছিলই। বুঝতে চেষ্টা করছিলাম, কী কী বিষয়ে রুবেল ভাইকে প্রশ্ন করা যেতে পারে। এক পর্যায়ে থিয়েটারের প্রসঙ্গে যেতেই উনি বললেন, ‘থিয়েটার নিয়ে আমি কিছু বলব না। এ বিষয়ে কোনো কথা হবে না।’ আরও বললেন, ‘ওই চ্যাপ্টার শেষ’।
অথচ আহমেদ রুবেল আমার সাথে এত আন্তরিক হয়ে কথা বলছিলেন আমি থিয়েটারের মানুষ বলেই হয়তো। থিয়েটারের মানুষেরা একত্রিত হলে পরিবারিক আন্তরিকতায় কথা হয় বলে ভাষ্য ছিল ওনার। আহমেদ রুবেলের ভাষায়, যে মানুষ থিয়েটার করে তার এমনিতেই কবিতা পড়া, গান শোনা, নানা ধরনের নাটক পড়া, সিনেমা দেখাসহ শিল্পের নানা শাখায় সে নিজের অজান্তেই আনন্দের তাগিদে বিচরণ করতে থাকে। তাঁর শিক্ষা চলতে থাকে সারা জীবন ধরে। আরও বলেছিলেন, থিয়েটার না করলে সমস্যা নাই, কিন্তু করলে যে বেনিফিট সেটা এক কথায় শেষ করা যাবে না।
অথচ এত কথার পরও আহমেদ রুবেল ক্যামেরার সামনে থিয়েটার নিয়ে কিছু বলতে চাইছিলেন না! নাছোড়বান্দা আমি বোঝানোর চেষ্টা করে যাই। অবশেষে সেটে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে তিনি ধীরে ধীরে রাজি হলেন থিয়েটার নিয়ে কথা বলতে।
শিল্প ও বাণিজ্য নিয়ে আহমেদ রুবেলের অবস্থান স্পষ্ট ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘শিল্পকে কখনও বাণিজ্যিক মানদন্ডে বিচার করা যাবে না। তবে বাণিজ্যিক ছবি শৈল্পিক মানদন্ড ছুঁতে পারে। শিল্প শিল্পের প্রয়োজনে চলবে, বাণিজ্যকে গ্রাহ্য করে নয়। আমরা যখন কাজ শুরু করেছি, তখন কোনো ইন্ডাস্ট্রি ছিল না। নাটক সিনেমার কোনো একাডেমিক স্ট্রাকচার ছিল না। আমরা কাজ করেছি শিল্পের তাড়নায়, প্রাণের তাগিদে। আমরা দীর্ঘদিন কাজ করার পর ইন্ড্রাস্ট্রি গড়ে উঠেছে। আমরা কোনো কিছু পাবো ভেবে কাজ করিনি। তাতে কী আসে যায়? শিল্প সাধনায় কত কত মানুষ পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই।’
ক্যান্টিনের চায়ের কাপ ও গুঞ্জন ছাপিয়ে উপস্থিত সবাইকে মোহবিষ্ট করে রেখেছিল আহমেদ রুবেলের ভরাট কণ্ঠ। সেটে যাওয়ার আগের প্রস্তুতি, লাঞ্চ এবং সাক্ষাৎকার—সব মিলিয়ে ৫টি ঘণ্টা যেন এক লহমায় কেটে গিয়েছিল।
কলেজে পড়াকালীন সময় থেকে সতীর্থদের নিয়ে আহমেদ রুবেল গড়ে তুলেছিলেন ‘সমকাল’ থিয়েটার। ঢাকা থিয়েটারে যুক্ত হোন সেলিম আল দীনের হাত ধরে, ১৯৮৭ সালে। তারপর তিন দশকের বেশি সময় ধরে ঢাকা থিয়েটারের সাথে কাজ করে গেছেন। কিত্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, হাতহদাই, একাত্তরের পালা, যৈবতী কন্যার মন, মার্চেন্ট অব ভেনিস, বনপাংশুলের মত কালজয়ী মঞ্চনাটকে ছিল তাঁর অভিনয়। মঞ্চে উঠেছেন পনের’শ বারের মত। সিনেমা করেছেন ২০টি। ৫৬ থেকে ৬০টি টিভি নাটকও করেছিলেন আহমেদ রুবেল।
যতবার থিয়েটারের প্রসঙ্গে এসেছে, ততবার রুবেলের চোখ জ্বলে উঠেছে থিয়েটারের আলোয়। সেদিন ক্যান্টিনে বা মেকাপ রুমের আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে অফিসের অনেকেই শুভেচ্ছা বিনিময় করছিলেন তাঁর সাথে। হাত মিলিয়ে যাচ্ছিলেন কেউ, কেউ তুলছিলেন ছবি। উনি মিটিমিটি হাসছিলেন। বোঝা গিয়েছিল যে, স্টেশনের সবার আন্তরিকতা ভালো লাগছে আহমেদ রুবেলের। দীর্ঘদিনের বিরতির পর আবার ফিরেছিলেন ‘প্রিয় সত্যজিৎ’ দিয়ে। জানিয়েছিলেন নিয়মিত কাজ করার ইচ্ছার কথা। ওটিটিতে কাজের আগ্রহও ছিল রুবেলের। তবে ‘পেয়ারার সুবাস’ নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। জানিয়েছিলেন, ‘পেয়ারার সুবাসের প্রিমিয়ারের সময় ফের আসব। এবার প্রসূন রহমানের সাথে আসছি। তখন আসব নুরুল আলম আতিককে নিয়ে।’
সেই ‘পেয়ারার সুবাস’ শেষ পর্যন্ত পেক্ষাগৃহে চলবে। আট বছর আগে শুরু হওয়া সিনেমা নানা জটিলতা কাটিয়ে আলোর মুখ দেখল ঠিকই। শুধু একজন মূখ্য অভিনেতা তার সুবাস পেলেন না। কিন্তু প্রিমিয়ার শো চলল। তাই হওয়ার কথা। কারণ শো মাস্ট গো অন। সেই সাথে এই আকস্মিক নাটকীয় প্রয়াণে সান্ত্বনা খুঁজছি এই ভেবে যে, আহমেদ রুবেলের প্রয়াণ একজন প্রকৃত শিল্পীর শেষ ইচ্ছার মতোই ঘটেছে। উনি সহায় ছিলেন, অসহায় নন। কর্মক্ষম ছিলেন, কর্মহীন নন। থিয়েটারের অনেকেরই শেষ ইচ্ছা থাকে মহড়াকক্ষে অথবা মঞ্চেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলার। অর্থাৎ অভিনয় জীবনে থাকতে থাকতেই চিরবিদায় নেওয়ার। আহমেদ রুবেলের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। একজন জাত শিল্পীর প্রস্থান ঘটেছে শিল্পীর সম্মান নিয়ে শিল্পকর্মের মধ্য দিয়েই।
মৃত্যুর ঠিকুজি আমাদের হাতে নেই। মৃত্যুকে আমরা থামাতেও পারি না। তাই চলুন, এই অমোঘ সত্যকে মেনে নিয়েই উৎসবে–উৎসর্গে এই শিল্পীর চিরবিদায়কে আমরা সম্মানিত করি। কী হতে পারত—সেসব কথা আপাতত থামিয়ে, রুবেলকে বিদায়ের আয়োজন করি তাঁর কর্মের মধ্য দিয়েই।
আমার কানে বাজছে শুধু একটা কথাই—‘আপনাদের অফিসের পরিবেশ খুব ভালো। পেয়ারার সুবাসের প্রিমিয়ারে নুরুল আলম আতিককে নিয়ে আসব। দেখা হবে। ভালো থাকবেন।’
আপনিও ভালো থাকবেন আহমেদ রুবেল। কর্মে বেঁচে থাকবেন।