বছর দুই‑তিন আগেও যেখানে ছিল ধু ধু মরুভূমি ও ধূসর পাহাড়, এখন সেই সব ধূসর পাহাড়গুলো সবুজে ছেয়ে গেছে। গাছ, ঘাস ও লতাপাতায় ছেয়ে গেছে মরুর পাহাড়। এ ছাড়া চলতি বছর প্রথমবারের মতো সেখানে দেখা গেছে বিরল তুষারপাত। এমন হয়েছে কোনো জাদুবলে নয়, আচমকাও নয়। বলছি সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলের দুই পবিত্র নগরী মক্কা এবং মদিনার কথা।
বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনই প্রকৃতির এই রূপবদলের প্রধান কারণ। সৌদি আবহাওয়া বিভাগ চলতি বছর খারাপ আবহাওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার সতর্কতাও জারি করেছে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, অঞ্চলগুলোতে আরও বজ্রঝড়, ভারী বৃষ্টিপাত এবং প্রবল বাতাসের আশঙ্কা রয়েছে। কর্মকর্তারা বাসিন্দাদের সাবধানতা অবলম্বন ও দৈনন্দিন কার্যক্রমে যাতে ব্যাঘাত না হয়, সেজন্য প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এমনিতে এই অঞ্চলে বৃষ্টি হয় না। সেখানে নাকি অতিবৃষ্টি। আর তাতেই জন্মেছে উদ্ভিদ, ধূসর পাহাড় হয়েছে সবুজ। সবুজে ছেয়ে যাওয়া পাহাড়গুলোর ছবি অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।
২০২১ সালের শেষ দিকে বৃষ্টিপাত হয়েছিল সৌদি আরবে। কিন্ত ২০২২ সালের শেষ দিকে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তা অন্য বছরের তুলনায় বেশি ছিল। এরপর ২০২৩ সালের শেষ দিক থেকেই এই এলাকা এভাবে সবুজ হয়ে উঠেছে। সে বছর নভেম্বরে সৌদি আরবের পশ্চিমাঞ্চল ছাড়াও উত্তর সীমান্ত লাগোয়া আল-জাওয়াফ, হায়েল, আল-কাশিমে তুমুল বৃষ্টি হয়। সতর্কতা জারি করেছিল দেশটির জাতীয় আবহাওয়া বিভাগ (এনসিএম)।
২০২৩ সালে শুরু হওয়া ওই বৃষ্টির ধারা কিন্তু অব্যাহত ছিল বিদায়ী ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। গত আগস্ট ও অক্টোবরেও ভারী বৃষ্টিপাতে আকস্মিক বন্যা হয় দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের মদিনা আল মুনাওয়ারা অঞ্চল। অনেক রাস্তাঘাট ডুবে যায়। বন্ধ হয় যানবাহন চলাচল। সৌদি আরবে এই বন্যা স্বাভাবিকভাবেই নজর কাড়ে সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে খবর ও বিশ্লেষণ প্রকাশ হয়েছে।
এ ছাড়া বছরের একদম শেষভাগে; অর্থাৎ, গত নভেম্বরে মরুভূমির দেশটিতে তুষারপাতের মতো বিরল ঘটনাও ঘটে। সে সময় সৌদির উত্তরাঞ্চলের আল-জউফ এবং তাবুক অঞ্চলে তুষারপাত ও শিলাবৃষ্টি হয়। আর এতেই নড়েচড়ে বসেন দেশটির আবহাওয়াবিদেরা।
আবহাওয়াবিদরা এমন অস্বাভাবিক আবহাওয়ার কারণ হিসেবে নিম্নচাপকে দায়ী করছেন। তাঁদের ভাষ্যমতে, নিম্নচাপের কারণে আর্দ্র বাতাস আরব সাগর থেকে ওমানের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। আর আর্দ্র বাতাসের কারণে সৌদি আরব এবং প্রতিবেশী দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিভিন্ন অঞ্চলে বজ্রঝড়, শিলাবৃষ্টি ও বৃষ্টিপাত হয়েছে।
তবে বৃষ্টি ছাড়াও মরুভূমির সবুজায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তির পেছনে কোটি কোটি ডলার খরচ করছে সৌদি সরকার। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে শুধু সৌদি আরব নয় গোটা অঞ্চলেই শুরু হয়েছে এই সবুজ বিপ্লব। ২০২১ সালে দেশটির প্রশাসন এ সম্পর্কিত একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে মরুভূমিতে বাঁচে এমন ৪৫ কোটি গাছ লাগাবে প্রশাসন। মনে রাখা দরকার এর আগে কাতার ঠিক এমন প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, যা বেশ সফলও হয়েছে।
এ ছাড়া সৌদি সরকার এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প শুরু করেছে। এর একটি হলো গ্রিন রিয়াদ প্রকল্প। বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে ও স্থানীয় পরিবেশ বিবেচনায় এ প্রকল্পের নকশা করা হয়েছে। এর আওতায় সৌদির রাজধানীতে ১২০টির বেশি আবাসিক এলাকায় বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে সবুজায়ন করা হবে। পাশাপাশি বনভূমি সংরক্ষণেরও চেষ্টা চলছে। সৌদি আরবে ২৭ লাখ হেক্টর বনভূমি রয়েছে। কোনোভাবেই যেন সেগুলোকে মরুভূমি গ্রাস করতে না পারে, সে জন্য নানা পদক্ষেপ করা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে সৌদি প্রশাসন ১৫টি এলাকাকে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ১২টি স্থলভাগে এবং তিনটি সমুদ্রের নিচে।
সম্প্রতি পুরো বিশ্বের মতো মধ্যপ্রাচ্যও অস্বাভাবিক আবহাওয়ার মুখোমুখি হচ্ছে। মরু অঞ্চলে সাধারণত কম বৃষ্টি হলেও এবারে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। আফ্রিকার সাহারা মরুভূমিতে গত ৫০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো বন্যা হয়েছে, যা ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। তাই মরু অঞ্চলের এই পরিবর্তন নিয়ে শুরু হয়েছে নানা বিশ্লেষণ।