গত কয়েক দশক ধরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও, যক্ষ্মা/ টিউবারকুলোসিস/ টিবি বিশ্বব্যাপী শীর্ষ সংক্রামক মরণব্যাধি হিসেবে রয়ে গেছে, যা প্রতি বছর বিশ্বে ১৫ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ। ‘ঔষধ-প্রতিরোধী-যক্ষ্মা/ ড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট-টিবি (ডিআর-টিবি)/ মাল্টিড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট-টিবি (এমডিআর-টিবি)’ একটি বড় স্বাস্থ্য হুমকি এবং যক্ষ্মা নির্মূলের প্রচেষ্টায় অর্জিত লাভকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। আসুন টিবি-র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একত্রিত হই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০০০ সাল থেকে যক্ষ্মা মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টা আনুমানিক ৭৯ মিলিয়ন জীবন বাঁচিয়েছে। তবে, যক্ষ্মা এখনও একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য হুমকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে যে শুধুমাত্র ২০২৩ সালেই ১ কোটি ৮ লাখ মানুষ এই রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল এবং ১২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।
প্রতি বছর ২৪শে মার্চ, ‘বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস’ পালন করা হয়। এই মারাত্মক রোগটি বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে আক্রান্ত করে চলেছে। উল্লেখ্য, ১৮৮২ সালের এই দিনে ডা. রবার্ট কোচ যক্ষ্মা রোগের জীবাণু ‘মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস ব্যাসিলাস’ আবিষ্কার করেন, যা যক্ষ্মার বিরুদ্ধে কার্যকর লড়াইয়ের সূত্রপাত করেছিল।
সেই সময়ে যক্ষ্মা একটি মহামারি ছিল, প্রতি সাতজনের মধ্যে একজনকে সংক্রমিত করত। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষার, চিকিৎসা ব্যবস্থার স্বল্পতা এবং সীমিত প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে এই রোগ সংক্রমণের উচ্চহার এবং উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে।
এই বছর বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস এর প্রতিপাদ্য হলো, ‘হ্যাঁ! আমরা যক্ষ্মা নির্মূল করতে পারি: প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, বিনিয়োগ করা ও সহযোগিতা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে’।
চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি, মার্কিন সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি)–এর জন্য তহবিল স্থগিত করার ঘোষণা দেয়, যা অনেক নিম্ন-আয়ের দেশে যক্ষ্মা প্রতিরোধ ও চিকিৎসা কর্মসূচির জন্য আন্তর্জাতিক দাতাদের প্রায় অর্ধেক তহবিলকে সমর্থন করে। এর মধ্যে রয়েছে রোগীদের প্রেসক্রিপশন অ্যান্টিবায়োটিকের জন্য সরাসরি তহবিল, পাশাপাশি ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরিবহনের জন্য লজিস্টিক সহায়তা, সম্প্রদায়ভিত্তিক কেস সন্ধানের জন্য অর্থ প্রদান এবং নতুন রোগ নির্ণয় এবং থেরাপি খুঁজে বের করার জন্য গবেষণা তহবিল।
এই তহবিল ছাড়া, যক্ষ্মা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং আরও বেশি লোকের মৃত্যু হবে, যারা সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় করা সম্ভব ছিল। উপরন্তু, অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসার আংশিক কোর্স করে রোগীরা অ্যান্টিবায়োটিক বন্ধ করে দিতে পারে, এতে ঔষধ-প্রতিরোধী-যক্ষ্মা স্ট্রেনগুলি আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ পাবে, যা পুনরায় শুরু হলে টিবি চিকিৎসাকে আরও জটিল এবং ব্যয়বহুল করে তুলবে। তবে, ইউএসএআইডি এবং অংশীদারদের দ্বারা পরিচালিত এবং সমন্বিত নজরদারি ছাড়া, এই তহবিল পরিবর্তনের প্রকৃত প্রভাব বোঝা কঠিন হবে।
বাংলাদেশে গত ৯ বছরে শনাক্ত যক্ষ্মা (টিবি) রোগী ৩০ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। শনাক্তের বাইরে রয়েছে অন্তত ২০ শতাংশ রোগী। শনাক্তদের মধ্যে ঔষধ-প্রতিরোধী-যক্ষ্মার নমুনা পাওয়া যাচ্ছে ১ শতাংশ রোগীর দেহে। এ নিয়ে নতুন করে চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য মতে, ২০১৫ সালে শনাক্ত রোগী ছিল ২,০৯,৪৩৮ জন। ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৩,০১,৫৬৪ জনে, এর মধ্যে ২,৪৩৭ জন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর। শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ পুরুষ ও ৪২ শতাংশ নারী। ঔষধ- প্রতিরোধী-যক্ষ্মা / ড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট-টিবি (ডিআর-টিবি)/ মাল্টিড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট-টিবি (এমডিআর-টিবি) রোগীর সংখ্যা ২,৭২৯ জন।
সরকারি হিসাবে, ২০১৫ সালে যক্ষ্মায় মৃত্যু হয়েছিল প্রতি লাখে ৪৫ জনের। ২০২৩ সালে সেটি কমে প্রতি লাখে হয়েছে ২৫ জন। সে হিসাবে দেশে যক্ষ্মায় মৃত্যু ৪২ শতাংশ কমেছে।
শনাক্তের বাইরে থাকা রোগী কিংবা যারা চিকিৎসা পুরোপুরি শেষ করে না, তাদের কারণে ঔষধ-প্রতিরোধী-যক্ষ্মা/ ড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট-টিবি (ডিআর-টিবি)/ মাল্টিড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট-টিবি (এমডিআর-টিবি) নতুন উদ্বেগ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ঔষধ-প্রতিরোধী-যক্ষ্মার চিকিৎসায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী ঔষধ খাওয়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সাধারণ যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ছয় মাস নিয়মিত ঔষধ সেবন করতে হয়। নির্দিষ্ট মাত্রায় নিয়মিত ও পূর্ণ মেয়াদে ঔষধ না খেলে যক্ষ্মার জীবাণু ঐ ঔষধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাংলাদেশে যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীদের অবহেলা ও অসচেতনতায় এই ঔষধ-প্রতিরোধী-যক্ষ্মা/ ড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট-টিবি (ডিআর-টিবি)/ মাল্টিড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট-টিবি (এমডিআর-টিবি) বাড়ছে, যাদের একটা বড় অংশই মারা যায়।
ঔষধ-প্রতিরোধী-যক্ষ্মায় আক্রান্তরা যে জীবাণু ছড়ায়, তা-ও ঔষধ প্রতিরোধী। তবে শনাক্তের পর নিয়মিত, পরিমিত ও পূর্ণ মেয়াদের চিকিৎসা নিলে এ রোগ ভালো হয়। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন সচেতন হওয়া।
যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীর সম্পর্কে দেশে এলাকাভিত্তিক পরিসংখ্যান এই মুহূর্তে নেই। তবে সাধারণত যেসব এলাকা দরিদ্র, জীবনযাত্রার মান খারাপ, যাদের খাদ্যে পুষ্টিমান কম, তাদের যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি হয়। সে ক্ষেত্রে একই সঙ্গে অনেক লোক বসবাস করে তেমন মানুষ বেশি ঝুঁকিতে থাকে। একই রুমে যখন চার-পাঁচজন থাকে এবং তাদের মধ্যে কারো যদি যক্ষ্মা হয়, তাহলে তার কাছ থেকে বাকিরাও যক্ষ্মায় আক্রান্ত হতে পারে।
নিয়মিত ঔষধ না খাওয়ার কারণে যক্ষ্মা রোগীরা ঔষধ প্রতিরোধী হয়ে যায়। এমন রোগী প্রথম দিকে পাওয়া যেত। এখন ঔষধ খায়নি এমন রোগীও ঔষধ-প্রতিরোধী-টিবিতে আক্রান্ত হচ্ছে, যাকে ‘প্রাইমারি ঔষধ-প্রতিরোধী-টিবি’ বলে। তারা ঔষধ-প্রতিরোধী-যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীদের দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, দেশে যত টিবি রোগী আছে, তাদের মধ্যে ঔষধ প্রতিরোধী রোগী শতকরা ১ থেকে ২ ভাগ। যদিও শিশুদের মধ্যে ঔষধ-প্রতিরোধী-টিবি অনেক কম। তবে তরুণদের মধ্যে এর হার বেশি। তাদের সচেতনতার ঘটতি রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার জিরো রোগী ও জিরো আউট অব পকেট কষ্ট (নিজের পকেটের খরচ না করা) নিশ্চিতে কাজ করছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এটি বাস্তবায়নে একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি সফল করতে হলে আমাদেরকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে হবে।
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মসূচি:
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লক্ষ্য হল টিকাদান, প্রাথমিক শনাক্তকরণ, চিকিৎসা, কমিউনিটি শিক্ষা এবং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর উন্নতির মতো কৌশলগুলির মাধ্যমে যক্ষ্মা সংক্রমণ এবং এর কারণে মৃত্যু কমানো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে টিবিকে জনস্বাস্থ্যের হুমকি হিসাবে বিশ্বব্যাপী নির্মূল করার লক্ষ্যে নির্দিষ্ট বছরের মধ্যে যক্ষার কারণে মৃত্যু এবং নতুন যক্ষ্মা রোগী হ্রাস করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।’
যক্ষ্মা প্রতিরোধের কৌশল:
টিবি প্রতিরোধের মধ্যে রয়েছে বিসিজি টিকা, দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং কার্যকর চিকিৎসা। স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ও যোগাযোগ করা।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পরিচালক, বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজ হসপিটাল, চট্টগ্রাম