আজ ৮ মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। প্রতিবছরের মতো এ বছরও পালিত হচ্ছে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। থ্যালাসেমিয়া রক্তের এক বিশেষ ধরনের অসুখ। এটা ক্যানসার নয়, ছোঁয়াচেও নয়। থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ। মানুষের শরীরে কোষের ভেতর যে জিন থাকে, সেই জিন এই রোগ বহন করে এবং বংশানুক্রমে ছড়িয়ে দেয়।
এবারের বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবসের প্রতিপাদ্য হল ‘থ্যালাসেমিয়ার জন্য ঐক্য: সবাইকে একত্রিত করা, রোগীদের অগ্রাধিকার দেওয়া।’ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের কেবল চিকিৎসাই নয় বরং মানসিক এবং সামাজিক চাহিদা পূরণের জন্য সামগ্রিক যত্নের প্রয়োজন। তাই সঠিক স্বাস্থ্যনীতি ও তা বাস্তবায়নের জন্য বৈশ্বিক ঐক্য প্রয়োজন।
থ্যালাসেমিয়া শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ ‘থ্যালাসা’ থেকে, যার অর্থ সমুদ্র। একসময় ধারণা করা হতো শুধু সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষেরই থ্যালাসেমিয়া হয়। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার দেশগুলোর মানুষের মধ্যে এই রোগের হার সবচেয়ে বেশি ছিল। তবে এটা ছিল কেবলই একটি ধারণা। ইউরোপিয়ান জার্নাল অব হেমাটোলজিতে প্রকাশিত ২০২০ সালের এক গবেষণাপত্রে উঠে আসে যে, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে থ্যালাসেমিয়া বাহকের হার সবচেয়ে বেশি।
থ্যালাসেমিয়া কী?
থ্যালাসেমিয়া রক্তের এক ধরনের রোগ। জিনগত ত্রুটির কারণে রক্তের হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে অস্বাভাবিকতা তৈরি হলে মানুষ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। এই রোগ হলে রক্তে হিমোগ্লোবিন উৎপাদন প্রয়োজনের চেয়ে কম পরিমাণে হয় বা একেবারেই হয় না।
লোহিত রক্ত কণিকা হিমোগ্লোবিন ব্যবহার করে দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহ করে। হিমোগ্লবিন কমে গেলে শরীরের ভেতরে অক্সিজেন চলাচল কম হয়। ফলে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তরা শারীরিকভাবে দুর্বল বোধ করে, তাদের ত্বক ফ্যাকাশে দেখায় ও তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হয়।
এছাড়া অরুচি, জন্ডিস, বারবার সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়া, পেট ব্যথা, শারীরিক বৃদ্ধিতে ধীরগতির মতো উপসর্গও দেখা যায় থ্যালাসেমিয়া হলে।
বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর সাত হাজার শিশু জন্ম নেয় থ্যালাসেমিয়া নিয়ে। এই শিশুদের মধ্যে থ্যালাসেমিয়ার উপসর্গ দেখা দেয় জন্মের এক থেকে তিন বছরের মধ্যে।
থ্যালাসেমিয়া কেন হয়?
থ্যালাসেমিয়া হওয়ার কারণ ত্রুটিপূর্ণ জিন, যা রক্তে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনকে প্রভাবিত করে। এটি একটি জন্মগত রোগ। অর্থাৎ একজন শিশু জন্মের সময়ই থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হয়ে থাকে। দুজন থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে যদি বিয়ে হয় তাহলে ২৫ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে যে সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগী হিসেবে জন্ম নেওয়ার। আর ৫০ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে বাহক হওয়ার।
থ্যালাসেমিয়া বাহকরা ত্রুটিপূর্ণ জিন বহন করলেও তারা নিজেরা থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হন না। তবে এই বাহকরা কখনো কখনো স্বল্পমাত্রার অ্যানিমিয়ায় ভুগতে পারেন। তাদের রক্তের লোহিত কণিকার আকৃতি স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট থাকে। আর এই ধরনের অ্যানিমিয়ার জন্য সাধারণত কোনো চিকিৎসাও নিতে হয় না।
সাধারণ রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই জানা যায় যে একজন ব্যক্তি থ্যালাসেমিয়া বাহক কি না। থ্যালাসেমিয়া বাহকরা কখনো থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত না হলেও দুর্বলতা বোধ করতে পারেন ও তাদের ত্বকে ফ্যাকাশে ভাব আসতে পারে।
চিকিৎসা
নিয়মিত ‘ব্লাড ট্রান্সফিউশন’ বা রক্ত পরিসঞ্চালন থ্যালাসেমিয়ার প্রধান চিকিৎসা। পাশাপাশি ট্রান্সফিউশনের ফলে শরীরে জমা হওয়া অতিরিক্ত আয়রনের কারণে রোগীর হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ আর অগ্নাশয়ে সমস্যা তৈরি হয়। পাশাপাশি ডায়বেটিস, লিভার সিরোসিসের মতো সমস্যাও তৈরি হতে পারে।
এসব শারীরিক সমস্যার সমাধানে ট্রান্সফিউশনের পাশাপাশি বিশেষ ওষুধও গ্রহণ করতে হয়। আর থ্যালাসেমিয়ার একমাত্র স্থায়ী চিকিৎসা বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লানটেশন। কিন্তু নানাবিধ ঝুঁকি আর খরচের কারণে খুব কম ক্ষেত্রেই বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন করা হয়ে থাকে।
থ্যালাসেমিয়া কি প্রতিরোধযোগ্য?
থ্যালাসেমিয়া আগে থেকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। একজন শিশুর বাবা-মা যদি থ্যালাসেমিয়া বাহক না হয়ে থাকেন, তাহলে ঐ শিশুর থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। বিশ্বে বেশ কয়েকটি দেশ শুধু পূর্ব সতর্কতা অবলম্বন করে থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নামিয়ে এনেছে। ইরান, সাইপ্রাস, গ্রীসে একসময় থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। এই দেশগুলো থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা কমিয়ে এনেছে।
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের প্রধান পথ বিয়ের আগে পরীক্ষা করে দেখা যে, স্বামী ও স্ত্রী থ্যালাসেমিয়া বাহক কি না। থ্যালাসেমিয়া বাহকদের মধ্যে বিয়ে না হলে এবং দুইজন থ্যালাসেমিয়া বাহক সন্তান জন্মদান না করলে পরবর্তী প্রজন্মে থ্যালাসেমিয়া রোগী জন্ম না নেওয়ার সম্ভাবনা প্রায় থাকে না।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রক্তরোগ বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়