২০১৯ সালের শেষভাগে করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) বিশ্বজুড়ে এক মারাত্মক স্বাস্থ্যসংকট তৈরি করেছিল। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বিশ্বব্যাপী জরুরি অবস্থার অবসান ঘোষণা করে, তবুও ভাইরাসটির অস্তিত্ব এখনও বিলীন হয়ে যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশে করোনা ভাইরাসের নতুন কিছু ভেরিয়েন্ট নিয়ে আবারও আলোচনার জন্ম নিয়েছে। গত ৪ঠা জুন দেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেও জারি করা হয় সতর্কতামূলক বার্তা।
মূল ঘটনা
বাংলাদেশে বিগত কয়েক মাস ধরে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার তুলনামূলকভাবে কম থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মে ২০২৫ থেকে সংক্রমণের সংখ্যায় সামান্য বৃদ্ধি ঘটেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা (WHO) অনুসারে, মে’ ১১ তারিখে ৭৩টি দেশে পজিটিভিটি রেট ছিল প্রায় ১১ শতাংশ, যা গত বছরের জুলাইয়ের (১২ শতাংশ) সমতুল্য এবং ফেব্রুয়ারির (২ শতাংশ) তুলনায় অনেক বেশি।
বাংলাদেশসহ আশপাশের অঞ্চলে LF.7, XFG, XEC, JN.1, ও N.B.1.8.1 নামের ভেরিয়েন্টগুলো ছড়াচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইসিডিডিআরবি। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা (WHO) এদের ‘Variant Under Monitoring’ হিসেবে চিহ্নিত করলেও এখন পর্যন্ত এগুলোকে গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা ০৬ হাজার ছাড়িয়েছে, যেটা আমাদের দেশের জন্য দুশ্চিন্তার বটে।
নতুন ভ্যারিয়েন্টের লক্ষণগুলো কী?
যতদূর জানা যাচ্ছে, নতুন এই ভেরিয়েন্টগুলোর উপসর্গ আগের মতোই- জ্বর, কাশি, গলা ব্যথা, দুর্বলতা প্রভৃতি। পার্থক্য হলো, অনেক ক্ষেত্রেই উপসর্গ এত হালকা থাকে যে অনেকে বুঝতেই পারেন না- তারা আক্রান্ত হয়েছেন। এই কারণে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে নীরবে। এবং তাতে করে, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী- বিশেষ করে বয়স্ক, শিশু, গর্ভবতী নারী ও দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য এসব ভেরিয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
আমাদের করণীয়
সতর্কতা ও স্বাস্থ্যবিধি: জনাকীর্ণ স্থানে বা অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শে মাস্ক পরা, হাত ধোয়া ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো সহজ অভ্যাসগুলো এখনও প্রাসঙ্গিক, বিশেষ করে যখন একটা নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা: জ্বর, কাশি, গলাব্যথা বা শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে দ্রুত পরীক্ষা করানো এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
টিকা চালিয়ে যাওয়া: ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর জন্য বুস্টার ডোজের ব্যবস্থা করা। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও, টিকা মৃত্যুহার ও গুরুতর অসুস্থতা রোধে এখনো কার্যকর। উন্নত বিশ্বে mRNA-ভিত্তিক হালনাগাদ ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে, যা ভবিষ্যতে আমাদের দেশেও চালু করা যেতে পারে।
সঠিক তথ্য: নেট দুনিয়ায় তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ছয়লাপ। কিন্তু, এর মধ্যে অনেক তথ্যই পুরোনো এবং ভ্রান্তিকর। তাই কোভিড মহামারি সংক্রান্ত সঠিক তথ্যের জন্য বিশ্বস্ত উৎস ( যেমন- স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ডব্লিউএইচও) অনুসরণ করা উচিত।
এছাড়া নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হতে পারে- নতুন ভেরিয়েন্ট শনাক্তে জিনোম সিকোয়েন্সিং বাড়ানো, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দিয়ে টিকাদান চালু রাখা, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রস্তুত রাখা, এবং জনগণকে সতর্ক কিন্তু আতঙ্কহীন রাখার জন্য প্রচারণা জোরদার করা।
গণসংক্রমণ, করোনার ওয়েভ ও লকডাউনের সম্ভাবনা
করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট গণসংক্রমণ বা আরো একটি ওয়েভ তৈরি করতে পারে কী না- এটি অনেকাংশেই নির্ভর করে জনসাধারণের আচরণ ও সচেতনতার ওপর। লকডাউন এখন আর উপযোগী নয়, স্বয়ং বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থাও এর পক্ষে নয়। বরং প্রয়োজন লক্ষ্যভিত্তিক পদক্ষেপ, যেমন- ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা, সচেতনতামূলক প্রচারণা এবং সময়মতো টেস্ট ও রিপোর্টিং। হাসপাতালে চাপ বাড়লে স্থানভিত্তিক ‘রেস্ট্রিক্টিভ মেজার’ নেওয়া যেতে পারে। তবে তার আগে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন ও অফিসে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। প্রতিষ্ঠানভিত্তিক নেওয়া যেতে পারে ‘রেসপন্স প্ল্যান।’ মাস্ক ব্যবহার ও হাত ধোয়ার অভ্যাসকে আবারও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে জোরদার করতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হলো- আমরা যেন আতঙ্কিত না হই, আবার উদাসীনও না থাকি। তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, এবং টিকাদানে গুরুত্ব দেওয়া- এই তিন কৌশলের উপর সামনের দিকের দিনগুলোর সফলতা নির্ভর করছে। সবশেষে মনে রাখা প্রয়োজন, ‘আতঙ্ক নয়, বিজ্ঞানভিত্তিক সচেতনতা’- এটাই এখনকার মূলমন্ত্র।
লেখক: এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য), রেসিডেন্ট, বিএসএমএম