আয়োডিন আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান থাইরয়েড গ্রন্থিকে হরমোন তৈরি করতে সহায়তা করে। এসব হরমোন শরীরের পাশাপাশি মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই আয়োডিনের ঘাটতি প্রয়োজনীয় থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন ব্যাহত হয়।
আয়োডিনের ঘাটতির দৃশ্যমান পরিণতি, যেমন গলগন্ড রোগ সম্পর্কে আমরা কম‑বেশি সবাই জানি। তবে এর অদৃশ্য কিছু প্রভাব রয়েছে, যা অনেকের হয়তো জানা নেই। বিশেষ করে মস্তিষ্কের মারাত্মক প্রভাব ফেলে আয়োডিনের ঘাটতি। আয়োডিনের অভাবের কারণে মস্তিষ্কের ক্ষতির ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, আয়োডিনের অভাবে বুদ্ধিমত্তা বা আইকিউ ১৫ পয়েন্ট পর্যন্ত কমতে পারে।
আয়োডিনের অভাবজনিত সমস্যা এক সময় খুব সাধারণ ছিল। এক শতাব্দি আগেও মিশিগানে প্রতি তিনজন বিদ্যালয়ের ছাত্রের মধ্যে একজনের গলগন্ড ছিল। ব্রিটেনে কিছু অঞ্চলে গলগন্ড এতটাই সাধারণ ছিল যে, এ অবস্থাকে ‘ডার্বিশায়ার নেক’ বলা হতো। এরপর খাদ্যদ্রব্যে আয়োডিন যুক্ত করা শুরু হয়, ফলে সমস্যাটি নাটকীয়ভাবে কমে যায়। ১৯৯০ সালে যেখানে ১১৩টি দেশে আয়োডিনের পরিমাণ ছিল অপর্যাপ্ত, ২০২০ সালে তা কমে ২১টিতে এসে দাঁড়ায়।
ব্রিটিশ সাময়ীকি দ্য ইকনোমিস্টের প্রতিবেদনে জানা যায়, ধনী দেশগুলোতে আয়োডিনের স্তর কমতে শুরু করেছে। আমেরিকায় ১৯৭০-এর দশকে প্রাপ্তবয়স্কদের মূত্রে আয়োডিনের গড় পরিমাণ প্রতি লিটারে ছিল ৩০০ মাইক্রোগ্রাম, যা ২০২০ সালে কমে ১১৬ হয়েছে। মূত্রে প্রতি লিটারে আয়োডিন ১০০-এর নিচে থাকা অপর্যাপ্ত।
আয়োডিনের ঘাটতির জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছেন অন্তঃসত্ত্বা নারীরা। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের নিজের এবং তাদের গর্ভের সন্তানদের সুস্থ রাখতে বেশি আয়োডিনের প্রয়োজন। গর্ভাবস্থায় আয়োডিনের ঘাটতি শুধু মা নয়, সন্তানের মানসিক বিকাশকেও প্রভাবিত করে। আয়োডিন শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য মায়েদের খাদ্যতালিকায় আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে।
অনেক মানুষ প্রতিদিনের আয়োডিনের চাহিদা পূরণ করে লবণ থেকে। আমেরিকা ও ইউরোপের কিছু অংশে এক শতাব্দী ধরে লবণে কৃত্রিমভাবে আয়োডিন যোগ করা হচ্ছে। তবে আয়োডিন যুক্ত করার বিষয়টি এখনও অপর্যাপ্ত। আলাদাভাবে খাবারে যোগ করা লবণ ‘টেবিল সল্ট’ অধিকাংশ ক্ষেত্রে আয়োডিনযুক্ত হয়, তবে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যগুলোর লবণ সাধারণত আয়োডিনবিহীন থাকে। গুরমিত ও হিমালয়ান পিংক সল্টের মতো লবণে পর্যাপ্ত আয়োডিন থাকে না।
ভিগানিজম (প্রাণিজ আমিষ না খাওয়া) এবং পরিবেশবান্ধব খাবার খাওয়ার প্রবণতা বর্তমানে মাছ‑মাংসের প্রতি অনেকের আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। অথচ মাছ‑মাংস আয়োডিনের প্রাকৃতিক উৎস। দুগ্ধজাত খাবারেও প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন থাকে। ডেইরি খামারিরা গবাদিপশুকে সুস্থ রাখতে পশুখাদ্যে আয়োডিন যোগ করে থাকেন। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে এক লিটার দুধে এক চামচ আয়োডিনযুক্ত লবণের চেয়ে বেশি পরিমাণ আয়োডিন থাকে। তবে প্রাণিজ দুধের বিকল্প খাবারে সাধারণত এমন আয়োডিন থাকে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আয়োডিনের ঘাটতি পূরণে বিভিন্ন দেশের সরকার কিছু সহজ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। প্রথমত, দারিদ্র্যসীমায় বাস করা মানুষের দৈনন্দিন খাবার তালিকা চিহ্নিত করে সেসব খাদ্যে আয়োডিন সংযোজন বাধ্যতামূলক করা। দুধের বিকল্প ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে ব্যবহৃত লবণ এই তালিকার শীর্ষে থাকতে হবে। অস্ট্রেলিয়া ও ডেনমার্কের মতো পাউরুটিতে আয়োডিনযুক্ত লবণ যোগ করা যেতে পারে। তবে নিয়ম করে দেওয়ার আগেই বড় বড় খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানিগুলো তাদের গ্রাহকদের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় এমন উদ্যোগ নিতে পারে।
দ্বিতীয়ত, আয়োডিন সাপ্লিমেন্টের সহজলভ্যতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্য। আমেরিকায় বর্তমানে প্রিনেটাল ভিটামিনের ২-৫ শতাংশ আয়োডিনবিহীন। এর গুরুত্ব সম্পর্কে জনস্বাস্থ্য বার্তা আরও স্পষ্ট হওয়া উচিত। যেসব অঞ্চলে মাটিতে আয়োডিনের পরিমাণ কম, সেসব অঞ্চলে কৃষকদের গবাদিপশুর খাদ্যে আরও আয়োডিন যোগ করার জন্য উৎসাহিত করা যেতে পারে।
এমন পদক্ষেপ জনস্বাস্থ্যের জন্য অনেকগুণ লাভজনক হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ১৯৯৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আয়োডিনযুক্ত লবণ গ্রহণ কর্মসূচি বিশ্বব্যাপী ৭২ কোটি মানুষের আয়োডিন ঘাটতির ক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক ভূমিকা পালন করেছে। যার ফলে স্নায়ুবিক উন্নতি ও মানুষের উপার্জন ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে, যার আর্থিক সুবিধা বছরে ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলার। এই প্রকল্পে দরিদ্র দেশগুলোর আয়োডিনের ঘাটতিতে থাকা ২০০ কোটি মানুষ উপকৃত হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এখন কথা হলো, অনেক সময় চিকিৎসকেরা লবণ কম খাওয়ার পরামর্শ দেন। ফলে একদিকে লবণ কম খাওয়ার এবং অন্যদিকে যথেষ্ট আয়োডিন গ্রহণের পরামর্শ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে। আবার অনেকে অতিরিক্ত আয়োডিন গ্রহণের ঝুঁকি নিয়েও উদ্বিগ্ন। তবে অতিরিক্ত আয়োডিনের চেয়ে কম আয়োডিন খাওয়া বেশি বিপজ্জনক হওয়ায় যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে।
বহুকাল ধরে বিশ্বের মানুষ প্রয়োজনীয় এ খনিজটি সরবরাহে অনেকটা ভাগ্যের ওপর বেশি নির্ভর করেছে। আর অবাক করা বিষয় হলো, বহু দেশ বাধ্যতামূলক আয়োডিন সংযোজন কর্মসূচি ছাড়াই জনস্বাস্থ্যে সফল হয়েছে। তবে আয়োডিনের ঘাটতি পূরণের জন্য কেউ এমন ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিলে, আয়োডিন ঘাটতিজনিত সংকট মারাত্মক বিপর্যয়ে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগবে না বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।