ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ভুয়া ভিডিও। তথ্য যাচাইকারী সংস্থা ডিসমিসল্যাবের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মার্চ ২০২৫-এর এক সপ্তাহেই ২৯টি ইউটিউব চ্যানেল অন্তত একটি করে ভুয়া ভিডিও প্রকাশ করেছে। মোট ২৮৮টি ভিডিও বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবকটিই অন্য উৎস থেকে কনটেন্ট কেটে তৈরি। অনেক ভিডিওতে ভুয়া শিরোনাম, থাম্বনেইল এবং মনগড়া বক্তব্য ব্যবহার করা হয়েছে।
যেমন– জনপ্রিয় টক শো সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দিনকে নিয়ে একটি ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে বিতর্ক পরিচালনা করছেন। দেখলে মনে হয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। কিন্তু ভিডিওটি ভুয়া। ছবি-কণ্ঠ মিলছিল না, ফুটেজ ছিল বিকৃত। তিনজনের ফুটেজ ভিন্ন উৎস থেকে কেটে জোড়া লাগানো হয়েছে।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ জুলাইয়ের আন্দোলনের পর পুলিশ এবং প্রশাসনিক বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। তবে শিরোনামে লেখা ‘সেনাবাহিনী সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিলেন হাসনাত’! যদিও সেনাবাহিনীর কথা ওই ভিডিওর কোথাও উল্লেখ করা হয়নি।
এমন শত শত ভিডিও ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ছে। এসব ভিডিওর অনেকগুলোতে খালেদ মুহিউদ্দিন, মাসুদ কামালসহ সংবাদমাধ্যমের বহু পরিচিত মুখ ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক দর্শক মনে করেন, এসব ভিডিও তাদের আসল চ্যানেল থেকে এসেছে। ফলে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
ভুয়া ভিডিওগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ডিসমিসল্যাব জানায়, এসব ভিডিওর ৪০ শতাংশ অন্তর্বর্তী সরকারকে আক্রমণ করে। এ ছাড়া এনসিপি, বিএনপি, ও আওয়ামী লীগও লক্ষ্যবস্তু হয়েছে।
প্রায় ৯০ শতাংশ ভিডিওতেই বিজ্ঞাপন ছিল, যা থেকে আয় করছে ভুয়া চ্যানেলগুলো। ইউটিউবও এই ভিউ থেকে লাভবান হচ্ছে। আর প্রকৃত কনটেন্ট নির্মাতারা হারাচ্ছেন দর্শক ও আয়।
কিছু ভিডিওতে দেখা যায়, কেউ কিছু বলেননি তবু শিরোনামে লেখা ‘বিস্ফোরক তথ্য ফাঁস’! এমন কিছু ভিডিওর বিষয়ে সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, ‘মানুষ ভাবে ভিডিওগুলো আমারই, অথচ আমি এমন কিছু বলিনি।’
এ বিষয়ে এএফপির বাংলাদেশ ব্যুরোর সাবেক ফ্যাক্ট-চেকিং এডিটর কাদরুদ্দিন শিশির বলেন, ‘কিছু কনটেন্ট নির্মাতা হয়ত অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে এবং ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করে ভিডিও তৈরি করে লাভবান হচ্ছেন। তবে কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ইচ্ছাকৃতভাবে অন্তর্বর্তী সরকারবিরোধী বক্তব্যকে রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহারের সম্ভাবনাই রয়েছে।’
ভুয়া ভিডিওগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও ছড়াচ্ছে। সরকার, বিরোধী দল, নতুন দল– সব পক্ষই নিজেদের মতো শেয়ার করছে।
বাংলাদেশে বরাবরই বেশি ভুল তথ্য ছড়াতে দেখা যায় ভিডিওর মাধ্যমে। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম প্রান্তিকেও ভিডিওর মাধ্যমে ছড়িয়েছে ৪২ শতাংশ ভুল তথ্য। এরপরই ছিল ছবি (২৫ শতাংশ) ও গ্রাফিক কার্ডের (১৯ শতাংশ) ব্যবহার।
এ বছরের প্রান্তিকেও ১২৫টি ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে সংবাদমাধ্যমের সোশ্যাল মিডিয়া ফটোকার্ড সম্পাদনা করে। এসব ভুল তথ্যের অধিকাংশই (৭১ শতাংশ) ছিল রাজনীতি সংশ্লিষ্ট। ভুয়া এসব গ্রাফিক কার্ডে সংবাদমাধ্যমের লোগো যুক্ত থাকায় এসব ভুল তথ্য বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠার ঝুঁকি তৈরি হয়। আবার সংবাদমাধ্যমের ফটোকার্ড নকল করে ভুয়া তথ্য ছড়াতে দেখা যায় বলে সত্যি ফটোকার্ডকে নকল বলে প্রচার করার চিত্রও দেখা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব বিভ্রান্তিকর ভিডিও শুধু সাংবাদিক নয়, দেশের সংবাদমাধ্যম ও রাজনীতিকেও বিপদগ্রস্ত করছে। তাই এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত।