চোখ বন্ধ করেও যে অভিনেতার অভিনয় ঠাওর করা যেত, তিনি আহমেদ রুবেল। তাঁর দরাজ গলা তাঁকে আলাদা করে ফেলত নিয়তই। চোখ বুঁজলেই ‘পোকা’তে ঘোড়া মজিদ বা ‘প্রেত’ নাটকের সেই রহস্যময় চরিত্রটি এখনো ঘুরেফিরে আসে। এমন সব চরিত্র যে অভিনেতা নিমিষেই ধারণ করতেন, আসলে তাঁকে পেয়েও আমরা সেভাবে পাইনি।
আহমেদ রুবেলকে নিয়ে অনেক ভাবনাই ঘুরেফিরে আসে। তার মধ্যে একটি হলো—কেন এই জাঁদরেল অভিনেতাকে পুরোপুরি ব্যবহার করা হলো না? আবার প্রশ্নটা ঘুরিয়ে এভাবেও করা যায়, তাঁর মতো ইনফ্লুয়েনশিয়াল বা মোর দ্যান পারফেক্ট অভিনেতা কেন এতটা আড়ালে থেকে গেলেন?
কাজের সূত্রে প্রায়ই কথা বলতে হয় শিল্পীদের সঙ্গে। নানাভাবে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার চেষ্টাও করেছি। কিন্তু উত্তর মেলেনি রুবেলের কাছে।
বড় জোর মৃদু হেসে ভরাট গলায় রুবেল বলেছিলেন, ‘এই তো শুরু করলাম।’ কিন্তু শুরুর চেয়ে তিনি থেমেই থেকেছেন বেশি। হুট করেই ডুবে থেকেছেন তাঁর ছায়াঘেরা আবাস গাজীপুরে।
এক সাক্ষাৎকারে রুবেল তাঁর এই ‘চুপ ডুব’ নিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রায় ৫০০ নাটক করেছি। আমি তো মনে করি কম করিনি। তবে অনেক বেশি করার সুযোগ ছিল। কিন্তু একটা কথা, আমার যদি স্ক্রিপ্ট পছন্দ না হয়, না খেয়ে থাকলেও আমি সেই কাজ করব না।’
অনেকটা ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে বলা এ কথার মধ্যে আমি দেখেছিলাম দৃঢ়তার চোয়াল। যেটা তিনি শেষ অবধি ধরে রেখেছিলেন।
মঞ্চ ও টেলি নাটকের বাইরে বহু সিনেমায় এ তারকাকে পাওয়া গেছে। ‘আখেরি হামলা’ চলচ্চিত্র দিয়ে সিনেমায় অভিনয় শুরু করেছিলেন। তাঁকে দেখা গেছে ‘চন্দ্রকথা’, ‘ব্যাচেলর’, ‘গেরিলা’, ‘দ্য লাস্ট ঠাকুর’, ‘পারাপার’ চলচ্চিত্রে।
নাটকের চেয়েও সিনেমাতে তাঁর আক্ষেপটা ছিল ভীষণ। ঢাকাই সিনেমার দুরবস্থা তাঁকে পোড়াত। রাজনীতি সচেতন আহমেদ রুবেলের মতে, চলচ্চিত্রে পচন ধরেছে নানা কারণে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দায়ী চলচ্চিত্রশিল্পের মানুষের ঘৃণ্য রাজনীতি।
আহমেদ রুবেল নামটা নিয়ে তিনি মজার তথ্য শুনিয়েছিলেন। মূলত এ অভিনেতার নাম ছিল আহমেদ রেজাউল ইসলাম। বাবা তাঁকে ডাকতেন ‘রুবল’ নামে। বড় ভাইয়ের নামটা ছিল ‘ডলার’। বাবাই মূলত রাশিয়া ও আমেরিকার দুই কারেন্সির নামে দুই ছেলের নামটা রাখেন।
মজার ছলে আহমেদ রুবেল নামের বিষয়টি নিয়ে বলেছিলেন, ‘গাইতে গাইতে যেমন গায়েন হয়, তেমনে ডাকতে ডাকতে আমি রুবেল হয়ে গেলাম। প্রথম জীবনে ভেবেছিলাম রাজনীতি করব। ভীষণ ডানপিটে ছিলাম। ভয়ংকর রকমের। তবে বাবার ভেটোর কারণে রাজনীতিতে নামতে পারিনি। কারণ তিনি সরাসরিই বলেছিলেন, যদি কোনো ঝামেলায় পড়ি, তিনি কখনোই এগিয়ে আসবেন না। এরপর থিয়েটার করার ভাবনা আসে। তখন বাড়িতে রুবল ডাকলেও বাইরের সবাই রুবেল বলতেন। এরপর কাজ করতে এলাম। রেজাউল নামটা লম্বা। তাই আহমেদের পর রুবেল দিলাম। কারণ সবাই রুবেল নামেই চেনেন।’
বন্ধু-বান্ধবের কারও কাছে তিনি রুবল, কারও কাছে রুবেল। প্রায়ই ‘নিখোঁজ’ হওয়া রুবেলের খোঁজ মিলত বন্ধুদের আড্ডাতে। সেটা গাজীপুরের নিজেদের বাড়িতে। বাড়ির ঠিক উঠোনোর পাশেই ছিল একটা স্কুল। যেখানে পড়ত বিশেষ শিশুরা। অটিজম বাচ্চাদের জন্য এটা করা। যা বন্ধুরা মিলে গড়ে তোলা। এই স্কুলটার জন্য নিজের বাড়ির নিচতলাটা খালি করে দিতে চেয়েছিলেন রুবেল। হয়তো করতে চেয়েছিলেন আরও এমন কাজ। যেটা হয়তো ভরাট কণ্ঠের চাপা স্বভাবের রুবেলের মতোই ‘আড়ালে’ থেকে গেল।