যদি প্রশ্ন রাখি, পৃথিবীতে একটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিসের ওপর নির্ভর করে? উত্তর হলো, যেই দেশে জনসংখ্যার তুলনায় প্রাকৃতিক সম্পদ বেশি, সেই দেশ অর্থনৈতিকভাবে বেশি উন্নতি লাভ করবে। স্বাভাবিকভাবেই অর্থনৈতিক তত্ত্ব বিবেচনায় উত্তরটা সঠিক। কেননা প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকলে উন্নতি কি দিয়ে হবে? জ্বলন্ত উদাহরণ হিসাবে দেখানো যেতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে। তরল সোনা বা প্রাকৃতিক তেলের ভান্ডার তাদের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে। আমাদের দেশের জনসংখ্যা অনেক, কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদ সে তুলনায় খুব বেশি নেই। তাই আমরা অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ। বিশাল বেকারত্ব ও দারিদ্রতা আমাদের নিত্যসঙ্গী। এটাই হলো আমাদের ব্যখ্যা বা অর্থনৈতিক তত্ত্বের বিশ্লেষণ।
কিন্তু শুধু কি তাই? শুধু প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ভর করেই কি অর্থনৈতিক উন্নতি করা যায়? দেশ গড়ার জন্য যে পরিকল্পনা, দূরদৃষ্টি ও সততা থাকা দরকার, তার কি কোন ভূমিকা নেই? সেটাই মূল আলোচ্য বিষয় এখানে। আমরা যদি আমাদের নিকট প্রতিবেশি সিঙ্গাপুরের দিকে তাকাই, তাহলে ব্যাপারটা কিছুটা স্পষ্ট হবে। সিঙ্গাপুর একটা ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র। তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ, কৃষি, উৎপাদনের জন্য চাষযোগ্য ভূমি, শিল্প উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় মানব সম্পদ—এসব কিছুই নেই। এক সময় এই দ্বীপরাষ্ট্রের অধিবাসীরা ছিল হতদরিদ্র, ছিল বিশাল বেকার জনগোষ্ঠী। তারই ফলশ্রুতিতে সামাজিক মরণব্যাধি মাদকাসক্তি ও দুর্নীতি আস্তে আস্তে তাদের দেশকে আর দেশের মানুষকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে মালয়েশিয়া থেকে বিছিন্ন হয়ে স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করায় প্রতিবেশি দেশগুলো, যেমন: মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া তাদের কোন সহায়তা প্রদানে অনীহা প্রকাশ করে। কিন্তু সেই মুহূর্তে প্রতিবেশিদের সাহায্য একান্ত প্রয়োজন ছিল সিঙ্গাপুরের। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তা বাধাগ্রস্থ হয়। এরপরও সিঙ্গাপুরের নেতৃত্ব দমে যায়নি। বরং তখন প্রচণ্ড দৃঢ়তার ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিল। তা না হলে আজ হয়তো সিঙ্গাপুর নামের কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকত না।
প্রতিবেশি দেশগুলোর সাহায্য না পেয়ে তারা পশ্চিমা দেশগুলোর দিকে হাত বাড়ায়। এই লক্ষ্যে তারা একটি বিনিয়োগবান্ধব নীতি প্রণয়ন করে। আর দুর্নীতি ও মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও তার প্রয়োগ নিশ্চিত করে। এছাড়া প্রথম থেকে সিঙ্গাপুরের সমুদ্র বন্দর একটা এন্ট্রি পোর্ট ছিল। সেই সাথে তাদের বিনিয়োগবান্ধব নীতি বিপুল বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সক্ষম হয়। প্রায় তিন হাজারের মতো বিদেশি কোম্পানি সিঙ্গাপুরে বিনিয়োগ করেছে। এর ফলে ধীরে ধীরে সিঙ্গাপুর আবির্ভূত হয় দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার এক অমিত শক্তিধর অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে। ১৯৬০ সালে দেশটির মাথাপিছু আয় ছিল সাকূল্যে ৩০০ ডলার, যা বর্তমানে ৬০ হাজার ডলার।
শুধু সিঙ্গাপুর নয়, আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে যাদের প্রাকৃতিক সম্পদ খুবই কম থাকা সত্ত্বেও অনেক অগ্রগতি লাভ করেছে। অনেক সম্পদশালী দেশও তাদের ধারে–কাছে যেতে পারেনি। এক্ষেত্রে জাপানও একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরমাণু বোমার ক্ষত নিয়ে উঠে দাঁড়ানো জাপান পৃথিবীর অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে নিজের স্থান করে নিয়েছে। আমরা যদি আফ্রিকা, এশিয়া আর ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে দেখব এদের প্রচুর সম্পদ থাকা সত্ত্বেও এরা হতদরিদ্র। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত এবং দেশ আন্তর্জাতিক ঋণের চাপে নিস্পেষিত। রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি এই দেশগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনীতির আকার, বৈশিষ্ট্য, জনসংখ্যার ঘনত্ব—এসবের কারণে দেশগুলোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তাই এক দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার সাথে আরেক দেশের পার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু নীতি ও পরিকল্পনা কার্যকরী হতে হবে। আর যদি তা সঠিকভাবে না হয়, তবে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব হবে না, এটা নিশ্চিত। আমরা যদি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকাই, তবে দেখব দেশটির অর্থনৈতিক উন্নতির মূলে ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিভাকে কাজে লাগানোর বিষয়টি। শুধু প্রাকৃতিক সম্পদই না, মার্কিন মুলুক সফলভাবে ইউরোপ, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার সব দেশের প্রতিভাকে আকৃষ্ট করেছে। আর তাদের দিয়ে অভাবিত উন্নয়ন সম্ভব করে তুলেছে। অন্যদিকে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল আয়তনে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি। এর বাইরে প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের হিসাবও আছে। ব্রাজিলে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বনভূমি আমাজন। কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও ব্রাজিলে দারিদ্রসীমার নিচে বাস করা লোকের সংখ্যা খুবই বেশি। সেখানে বিশাল জনগোষ্ঠী বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করে। যদিও বর্তমানে ব্রাজিলের দেশজ উৎপাদনে উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা–আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। আয়ের দিক থেকে উচ্চ বৈষম্য ও মাদকের কালো ছায়া দেশটিকে গিলে খাচ্ছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক বা প্রযুক্তিগত কোন সূচকেই দেশটি যুক্তরাষ্ট্র ধারে–কাছে পৌঁছাতে পারেনি। অথচ প্রাকৃতিক সম্পদের বিবেচনায় সমকক্ষ না হলেও যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি থাকার কথা ছিল ব্রাজিলের। কিন্তু কেন নেই? উত্তর সেই নীতির অভাব, দুর্নীতি ও ভ্রান্ত পরিকল্পনা। যা এক শ্রেণির মানুষকে লাভবান করার জন্য লাখ লাখ মানুষকে হতদরিদ্র, অসহায় ও অভাগা জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে। আমাদের একেবারে নিকট প্রতিবেশি মিয়ানমারের উদাহরণ আরও স্পষ্ট। বিপুল সম্পদশালী দেশটি এখন অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। এই রকম উদাহরণ আরও আছে।
এবারে আসি আমাদের দেশের কথায়। যদিও আমরা জানি বাংলাদেশে খনিজ সম্পদের তেমন একটা মজুত নেই, কিন্তু বাংলাদেশের অন্যান্য অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, যা ঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যা পুরোপুরি কাজে লাগাতে না পারার কারণে সৃষ্টি হয়েছে বেকারত্ব। মানুষ জীবিকার অন্বেষণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশান্তরিও হচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে সস্তা শ্রমের দেশ হিসেবে। কিন্তু মানবসম্পদই হচ্ছে একটা দেশের সব থেকে বড় সম্পদ। এটাকে কাজে লাগিয়ে উচ্চপ্রবৃদ্ধি অর্জন করা যায়। এছাড়াও আমাদের জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ তরুণ প্রজন্মের। একে অর্থনীতির ভাষায় ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। এর সময়োপযোগী সফল ব্যবহার অর্থনীতিকে উচ্চ মাত্রায় নিয়ে যায়। আমাদের এখন সেই সময় চলছে। আমাদের সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া দরকার কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে। এই লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প স্থাপনে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখানে মূখ্য ভুমিকা পালন করতে হবে। মুনাফার কথা ভেবে শুধু বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থায়ন করা একটা প্রচলিত নীতি আমাদের দেশে। এর পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি, এমনকি কুটির শিল্পগুলোকেও ব্যাপকভাবে সহায়তা দিলে শিল্পায়ন গতি পাবে। এতে বেকারত্ব যেমন কমবে, তেমনি উন্নয়নের গতি বাড়বে। চীন এই নীতিতেই অবিশ্বাস্য উন্নয়ন অর্জন করেছে।
সবশেষে বলা যায় যে, শুধু সম্পদের ভান্ডার নয়, সম্পদের ব্যবহার ও সুষম বণ্টনই হল উন্নয়নের চাবিকাঠি। মরুভূমির স্থান দুবাই আজ পৃথিবীর অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু আমাদের পর্যটন শিল্প বিকাশের সহায়ক সব উপাদান থাকা সত্ত্বেও বিকশিত হতে পারেনি। আশা করা যায়, পরিকল্পনাবিদেরা বিষয়গুলো ভেবে দেখবেন। কেননা উন্নতির মূলমন্ত্র এখানেই নিহিত।
ড. ইজাজ আহসান: লেখক ও গবেষক