আমার নাম আসেল। আমার বয়স ২৫। আমি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতোকোত্তর পড়ছি। আমার জীবন অনেক সাধারণ। আমি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করি। পাশাপাশি স্থানীয় একটি কোম্পানিতে গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছি। আমি বিড়াল অনেক পছন্দ করি। আমার নিজের দুটি বিড়াল আছে। আমি আমার জীবন নিয়ে সুখেই ছিলাম।
কিন্তু গত ৭ অক্টবরের পর গাজায় যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তাতে আমার সাদামাটা জীবন অনেক কঠিন হয়ে উঠেছে। স্বপ্ন ছিল শান্তিপুর্ণ এক জীবনের। কিন্তু কখন যেন তা বদলে রূপ নিল হৃদয়বিদারক বাস্তবতায়। এখন আমার উদ্বাস্তুর জীবন, প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকা যেখানে সংগ্রামের।
সাতবার ঘর হারিয়ে এখন আমার স্থান হয়েছে উপত্যকার মধ্যাঞ্চলের একটি তাঁবুতে। এ এক কঠিন সংগ্রামের জীবন। নিরাপত্তার তাগিদে আমাদের কয়েকবার স্থান বদলাতে হয়েছে এবং সাক্ষী হয়েছি যুদ্ধের নির্মম বাস্তবতার। এটা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে গভীর ছাপ ফেলছে।
আমার স্বপ্ন ছিল খুবই সাধারণ। চেয়েছিলাম আমার একটি গাড়ি থাকুক, বন্ধুদের নিয়ে কফি খাওয়া চলবে। প্রতিদিন সকালে কাজে যাব, আর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে মায়ের সঙ্গে সময় কাটাব এবং বিড়ালদের সঙ্গে খেলব। দুঃখজনকভাবে এই স্বপ্ন এখন প্রতিস্থাপিত হয়েছে প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার কঠিন বাস্তবতায়।
গত বছরের ৯ অক্টোবর আমরা বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি। প্রয়োজনের তাগিদে বড় বিড়ালটিকে আমার সেখানেই ফেলে আসতে হয়। ছোট বিড়ালটি মিসাইল আর বোমার তীব্র শব্দে অনেক ভয় পাচ্ছিল। তাই ওটাকে সঙ্গেই রেখেছিলাম। আশা ছিল, হয়তো শিগগিরই বাড়িতে ফিরে আমার বিড়ালটিকে জড়িয়ে ধরব।
যুদ্ধ শুরুর পর ১৬০ দিন পেরিয়ে গেছে। ভেঙে যাওয়া হৃদয়ে বলছি, আমাদের এই ধ্বংসস্তুপ থেকে বা এরচেয়েও বাজে পরিস্থিতি থেকে আবার নতুন জীবন শুরু করতে হবে। আমি আমার সব হারিয়েছি। অল্প অল্প টাকা বাঁচিয়ে এগুলো কিনেছিলাম। আমার ক্যামেরা, আমার ল্যাপটপ, আমার নিজের অফিস, আমার বিছানা, আমার বাড়ি, বাবার গাড়ি, কিছুই আর এখন নেই।
প্রতিদিনের জীবন চালাতে যা প্রয়োজন, তাও এখন আমাদের নেই। থাকার জন্য নিরাপদ একটি ছাদ, পর্যাপ্ত খাবার এবং পুষ্টি, স্বাস্থ্যকর ও পরিষ্কার পানি নেই। যুদ্ধ শুরুর পর বিদ্যুৎ নেই, নেই ইন্টারনেট। ছয় মাস ধরে চলমান এ যুদ্ধের মধ্যে এই জিনিসগুলো এখন বিলাসদ্রব্য।
তিনটি পরিবারের ২৪ জন মানুষের সঙ্গে এখন একটি তাঁবুতে আমাদের বাস। আমাদের সবার জন্য বাথরুম একটি, একটি কমন স্পেস। একজন প্রতি ১০ থেকে ১৫ দিনে একবার গোসলের সুযোগ পাই। যার সামর্থ্য আছে, সে খড়ি দিয়ে পানি গরম করে নিতে পারে। এখানে সবচেয়ে কঠিন হলো পানি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আনা–নেওয়া করা। আমার ভাইকে প্রতিদিন এক কিলোমিটার দূর থেকে ৫০ লিটার পানি নিয়ে আসতে হয়। প্রতিদিনের ব্যবহার, বাসন ধোওয়া, গোসল করার জন্য পানি অবশ্যই বিনা মূল্যে পাওয়া যায় না। প্রতি ১০ লিটার পানির জন্য গুনতে হয় প্রায় ৫ ডলার করে।
এখানে এখন শীতকাল। এর মধ্যে যখন বৃষ্টি হয়, তখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে ওঠে। বৃষ্টি হলে ক্যাম্পে পানি জমে যায়। তখন মাঝরাতে ওঠে আমাদের তাঁবু থেকে পানি সরাতে হয়, যাতে করে আমরা ঘুমাতে পারি। তাঁবুর ছাদে বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে আতঙ্ক, আশঙ্কা আর ঠান্ডাও জেঁকে বসে।
এখানে ইন্টারনেট পাওয়াও খুব সহজ নয়। যুদ্ধের কারণে ইন্টারনেটের তারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য আমাদের দুর্বল লাইনের প্যাকেজ কিনতে হচ্ছে। আধঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ এখন ৩ ডলারে পৌঁছেছে। যদি সারা দিনের জন্য কেউ ইন্টারনেট চায়, তাকে গুনতে হবে ৫০ ডলার, প্রতিদিন।
মোবাইল বা ডিভাইসগুলো চার্জ করাও যথেষ্ট কঠিন। পুরো গাজার কোথাও এখন বিদ্যুৎ নেই। আমি যদি আমার ফোন চার্জ করতে চাই, তাহলে আমাকে অন্তত ৩ কিলোমিটার দূরে যেতে হবে। গাজার কিছু তরুণ তাঁবুতে সোলার প্যানেল স্থাপন করে ফোন চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। তাদের ফোন দেওয়ার পর অন্তত ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে হয়। আমি যদি ৫০ শতাংশ চার্জ করতে চাই, তাহলে আমার খরচ ৬ ডলার। আর পুরো চার্জের জন্য ১৫ ডলার। এটা অনেক সময় কম–বেশি হয়, নির্ভর করে কতজন মানুষ ফোন চার্জ করার লাইনে অপেক্ষা করছে, তার ওপর। এ ছাড়া সূর্য ও আবহাওয়ার ওপরও এটি নির্ভর করে।
এখানে যারা আছেন, তাদের সবারই আর্থিক ও মানসিক সমর্থন প্রয়োজন। এখানে গরীব বা ধনী কারোরই কোনো আয় বা কাজ নেই। হঠাৎ করে এই অঞ্চলের অর্থনীতি থমকে গেছে। সব ব্যাংক ও কোম্পানিগুলো বন্ধ। বাইরের কোম্পানিগুলোও এই অঞ্চলের কর্মীদের সঙ্গে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন। ইউএনআরডব্লিউএ, ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করা সবচেয়ে বড় সংস্থা, তাদের সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছে। ত্রাণও যেমন বন্ধ; একই সঙ্গে বন্ধ কর্মীদের বেতনও। গাজায় এই সংস্থার কর্মী সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার।
এখানে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা সবকিছুর ভয়াবহ দাম। একটি পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত খাবার কেনা কঠিন হয়ে পড়েছে। খাদ্য সংকটের কারণে একজনের খাবার পুরো পরিবারকে ভাগ করে খেতে হচ্ছে। এটি পাওয়াও যেমন কঠিন, দামও অনেক বেশি।
সবজির দামের একটি উদাহরণ দিই—যদিও সব সবজি এখানে পাওয়া যাচ্ছে না। অল্প কিছুই পাওয়া যায়। একটি শসার দাম ১৩ ডলার, একটি টমেটো ১২ ডলার, একটি মরিচের দাম ১০ ডলার, আর একটি বেগুন কিনতে গুনতে হবে ১৫ ডলার।