দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া-বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকায় এলেই তাঁকে ঘিরে সমাজের বিভিন্ন স্তরে একটি আগ্রহ তৈরি হয়। জন্ম হয় অনেক প্রশ্ন ও কৌতূহলের। সেই আগ্রহ থেকেই গতকাল বুধবার ডোনাল্ড লুর সাথে বিস্তারিত কথা বলেন ইনডিপেনডেন্ট টিভির বিশেষ প্রতিনিধি ও কূটনৈতিক প্রতিবেদক নাফিজা দৌলা। সেখানে উঠে আসে নানা সংবেদনশীল বিষয়। পড়ুন সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত:
নাফিজা দৌলা: স্বাগতম, সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু।
ডোনাল্ড লু: ধন্যবাদ, নাফিজা। আজ আপনার শোতে উপস্থিত হওয়াটা সত্যিই সম্মানের।
নাফিজা: শুভসন্ধ্যা
ডোনাল্ড লু: ওহ, আপনাকে ধন্যবাদ।
নাফিজা: আমরা কিছু কঠিন প্রশ্ন দিয়ে আমাদের ইন্টারভিউ শুরু করতে চাই।
ডোনাল্ড লু: আজ দেখি আপনি শুধু কঠিন প্রশ্নের মধ্যে আছেন।
নাফিজা: আরে এটাই বাংলাদেশে জনপ্রিয়।
ডোনাল্ড লু: প্লিজ, শুরু করুন।
নাফিজা: আপনি কি র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার অগ্রগতি সম্পর্কে একটি আপডেট জানাবেন? বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মোকাবিলা করছে বলে দাবি করে। এই দাবির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়ন কী?
ডোনাল্ড লু: ধন্যবাদ। র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। আমি এক বছর আগে এখানে ছিলাম। সেই সময় আমরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ র্যাব সম্পর্কে যে বিবৃতি দিয়েছিল, সে বিষয়ে কথা বলেছিলাম। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, গত বছর র্যাব নাটকীয়ভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের সংখ্যা কমিয়েছে। এটা সত্যিই ভালো অগ্রগতি। আমাদের এখনো উদ্বেগ রয়েছে। আমরা দেখছি যে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অন্যান্য শাখা এখনো এই ধরনের কিছু অপরাধ করছে। র্যাবের অতীতের অপরাধের জবাবদিহি নিশ্চিত হবে কিনা, তা দেখার জন্যও আমরা অপেক্ষা করছি। তাই এটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি জানি বাংলাদেশ সরকার প্রক্রিয়াটি নিয়ে অধীর হয়ে আছে। আমাদের একটি প্রক্রিয়া আছে। যা আমাকে চিন্তিত করে তা হলো—গত বছরই হত্যা ও গুমের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। আমার কাছে এর অর্থ হচ্ছে, র্যাব মানবাধিকার লঙ্ঘন ছাড়াই তার গুরুত্বপূর্ণ সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম এবং আইন প্রয়োগের কাজ পরিচালনা করতে পারে। আর সে জন্য আমি আশা করি বাংলাদেশিরাও খুশি হবেন।
আমেরিকা বাংলাদেশে তার স্বার্থকে আমেরিকার স্বার্থের লেন্স দিয়েই দেখে। আমরা এটাকে চীনের স্বার্থ বা ভারতের স্বার্থ বা রাশিয়ার স্বার্থের লেন্স দিয়ে দেখি না। আমাদের এখানে গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রয়েছে এবং আমরা আমাদের বাংলাদেশি বন্ধুদের সাথে সরাসরি আলোচনা করেছি। আমি মনে করি সেগুলো ফলপ্রসূ এবং দরকারি আলোচনা।
নাফিজা: তাহলে কি কোনো ভালো খবর আছে?
ডোনাল্ড লু: খবর শুধু এটুকুই যে, সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার প্রক্রিয়া চলছে। আমার আরেকটি বিষয় যোগ করার আছে। তা হলো—গত বছরের সুলতানা জেসমিনের ঘটনাটিও আমাদের মনে আছে। আর তাই আমরা সরকারের সাথে কথা বলেছি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের মানুষ বিচারের অপেক্ষায় আছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের অংশীদার হিসেবে আমরাও অপেক্ষায় আছি।
নাফিজা: যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০টি বোয়িং বিমান কেনার প্রক্রিয়া বর্তমানে আলোচনার পর্যায়ে আছে। এই আলোচনার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাই?
ডোনাল্ড লু: আমি একটি কথা বলব যে, বিমান এয়ারলাইনস এবং বোয়িং মধ্যে থাকা দীর্ঘ সম্পর্ক নিয়ে আমরা খুবই গর্বিত। বোয়িং করপোরেশন, বিমানের পুরো বহর এখন বোয়িংয়ের। এবং বিমানের পরবর্তী কেনাকাটার জন্য এখন প্রতিযোগিতা চলছে। তাই বোয়িং এবং বিমানই কেবল এর অগ্রগতি সম্পর্কে বলতে পারে। তবে আমরা প্রতিযোগিতায় আছি বলে উচ্ছ্বসিত। আমরা আশা করি যে, বিমান সাবধানতার সাথে বোয়িং এবং অন্যান্য প্রতিযোগীদের কাছ থেকে আসা প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করবে এবং সেরা প্রস্তাবই জয়ী হবে।
নাফিজা: আপনি কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের মধ্যে প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা চুক্তি, বিশেষ করে জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট জিসোমিয়া এবং অ্যাকুইজিশন ক্রস–সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্ট আকসা চুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আপডেট দিতে পারেন?
ডোনাল্ড লু: এগুলো খুবই কৌশলী প্রশ্ন। জিসোমিয়া হলো আমাদের বিশ্বের অনেক সরকারের সাথে একটি চুক্তি, যা আমাদের সংবেদনশীল সামরিক তথ্য শেয়ার করার অনুমতি দেয়। এবং এটিতে বলা হয়, আমরা আপনার তথ্য রক্ষা করব এবং আপনি আমাদের তথ্য রক্ষা করবেন। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি যুক্তরাষ্ট্র থেকে জটিল ইলেকট্রনিক্স, সেন্সর, রাডারসহ কিছু সরঞ্জাম কিনতে চান, তবে আপনার একটি জেসন দরকার। তাই আমরা এই বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছি। তবে বেশির ভাগ দেশ এই আলোচনাগুলোতে বেশ সময় নেয়। আকসা একটি অত্যন্ত জটিল সামরিক চুক্তি, যা বাংলাদেশি সামরিক বাহিনীকে আমাদের সেবা প্রদান করতে দেয় এবং তারা আমাদের সামরিক বাহিনীকে সেবা প্রদান করতে পারে। আমরা আসলে এখনো এই ধরনের চুক্তি সম্পর্কে কথা বলছি না।
নাফিজা: ধন্যবাদ। যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অভিযোগ আসছে। মার্কিন প্রশাসন কীভাবে এই ধরনের উদ্বেগের প্রতি সাড়া দেয়, বিশেষ করে অন্যান্য জাতির ওপর তার নিজস্ব মানবাধিকার প্রতিবেদনের আলোকে?
ডোনাল্ড লু: একজন আমেরিকান হিসেবে আমি মনে করি, আমাদের আমেরিকানদের বিনয়ী হওয়া উচিত। আমাদের দেশে মানবাধিকারের সমস্যা আছে এবং এটা সত্য। আমরা যখন বাংলাদেশে মানবাধিকারের সমস্যা দেখি, তখন সে কথা তুলে ধরি। এবং আমাদের অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের কাছে আমরা আশা করি, যদি তারা সমস্যা দেখতে পায়, তাহলে তাদেরও উচিত সে বিষয় আমাদের কাছে তুলে ধরা। আমার দুই সন্তান আছে, দুজনই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আমেরিকায় এখন যা ঘটছে, সে সম্পর্কে আমার বাচ্চাদের কাছ থেকে অনেক অভিযোগ শুনতে পাচ্ছি। সরকারের অংশ হিসেবে আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বললে বলতে হয়, গত কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েল এবং গাজার পরিস্থিতি নিয়ে আমার দেশে হাজার হাজার বিক্ষোভ হয়েছে। প্রায় সব বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ ছিল এবং স্বাভাবিকভাবেই সেগুলো চলতে দেওয়া হয়েছে। আমরা সমাবেশের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতাকে সম্মান করেছি। কিছু কিছুক্ষেত্রে সহিংসতা, ভাঙচুর এবং ঘৃণামূলক বক্তব্যের ঘটনা ঘটেছে। আমাদের প্রেসিডেন্ট যেমন বলছেন, আমেরিকায় ঘৃণামূলক বক্তব্যের কোনো স্থান নেই। ফলে এ ধরনের ক্ষেত্রে কখনো পুলিশকে জড়িত হতে হয়েছে, কখনো গ্রেপ্তারও হয়েছে। এখন, আমি কিছু আমেরিকান এবং কিছু বাংলাদেশিকে জানি, যারা প্রশ্ন তুলেছে যে, পুলিশ সর্বদা সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, নাকি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বলপ্রয়োগ করেছে। যেসব জায়গায় পুলিশের এ ধরনের প্রতিক্রিয়া নিয়ে অভিযোগ উঠেছে, সেখানে তদন্ত হচ্ছে। যদি পুলিশ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বলপ্রয়োগ করেছে বলে প্রমাণিত হয়, তবে তার জবাবদিহি করতে হবে। গণতন্ত্রে তাই হয়। আমাদের বাংলাদেশি বন্ধুরা আমাদের বাধ্যবাধকতা মনে করিয়ে দিচ্ছে বলে আমরা অত্যন্ত খুশি।
গত বছর কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। সেই অভিজ্ঞতা সত্যিই আমাকে প্রভাবিত করেছে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির। আমি বাংলাদেশি জনগণের উদারতা ও সহানুভূতি দ্বারা অনুপ্রাণিত। আপনি আপনার দেশে এক মিলিয়ন মানুষকে স্বাগত জানিয়েছেন। এটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য বোঝা। আমরা সেই বোঝা ভাগ করে নিতে চাই।
নাফিজা: ধন্যবাদ। বাংলাদেশে বিএনপি ও বিরোধী দলগুলোর বিষয়ে আসি। আপনি বিএনপির সম্পর্কে জানেন। তাদের দাবি, ভারতের মধ্যস্থতায় প্রভাবিত হয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজের অবস্থান শিথিল করেছে। বিএনপি নেতাদের এসব দাবির বিষয়ে আপনার মতামত কী?
ডোনাল্ড লু: এটা খুবই হাস্যকর দাবি। আমরা একটি বড় দেশ। বিশ্বজুড়ে আমরা আমাদের স্বার্থ দেখি। যুক্তরাষ্ট্রকে কেউ বলে না কী করতে হবে। আমরা বাংলাদেশকে বলি না কী করতে হবে। যে কোনোভাবেই হোক এই ধারণা, যেখানে বলা হচ্ছে অন্য দেশের কথায় আমরা চলছি, তা সত্য থেকে অনেক দূরে। আমরা বাংলাদেশের জনগণের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, অহিংস নির্বাচনের যে চাওয়া, তার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। গত বছর আমরা একে উন্নতি করতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। সহিংসতা বা ভোটারদের পীড়ন করা পুলিশ, বিরোধী দল ও ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছি। আমরা বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে অর্থবহ সংলাপের পক্ষেও কথা বলেছি। আমরা বাকস্বাধীনতা ও সমাবেশের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছি। এটা স্বাভাবিক। এই অঞ্চলে এটিই আমাদের চাওয়া এবং আমরা বাংলাদেশেও সেই মূল্যবোধগুলোই বজায় রাখব।
নাফিজা: নির্বাচনের পর উভয় দেশই বাণিজ্য, জলবায়ু পরিবর্তন এবং নিরাপত্তার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং সম্পৃক্ততা বাড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করছে। যুক্তরাষ্ট্র কি দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনার উৎস হিসেবে শাসন ও মানবাধিকার ইস্যুকে একপাশে সরিয়ে রাখার পথ বেছে নিয়েছে?
ডোনাল্ড লু: আমাদের সম্পর্কে কিছু খুব কঠিন সমস্যা আছে। এটা কোনো গোপন বিষয় নয় যে, গত বছর নির্বাচন ইস্যু নিয়ে অনেক উত্তেজনা ছিল। উপরন্তু আমরা একসাথে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কাজ করছি। আমরা মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছি। আমরা ব্যবসার পরিবেশের উন্নতির কথা বলছি। আর এগুলো জটিল বিষয়। উদাহরণস্বরূপ শ্রম অধিকারের কথা বলা যায়। এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার আমাদের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই যৌথ কাজের অগ্রগতি ধীর এবং এটি সময়সাপেক্ষ। আমি সরকারকে যা বলেছি তা হলো—আসুন আমরা কঠিন সমস্যাগুলোর পাশাপাশি সহযোগিতার কিছু নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করি। আসুন একটি ইতিবাচক অ্যাজেন্ডা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। কারণ, আমার বিশ্বাস হলো—আমরা যদি কিছু ইতিবাচক কাজ করতে পারি, যেমন দুই দেশের মধ্যে শিক্ষার্থী বিনিময় বাড়ানো, বাণিজ্যে বিনিয়োগ বাড়ানো, পরিবেশবান্ধব জ্বালানি নিয়ে কাজ করার উপায় খুঁজে বের করা, যাতে বাংলাদেশ তার পরিবেশ উন্নত করতে পারে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নিতে পারে। আমরা যদি এই জিনিসগুলো করতে পারি, আমি মনে করি এটি কঠিন সমস্যাগুলোর সমাধানকে সহজ করে তুলবে।
নাফিজা: বাংলাদেশে একটি প্রচলিত বিশ্বাস রয়েছে যে, দিল্লির স্বার্থের লেন্সে ঢাকার অবস্থানকে বিবেচনা করে ওয়াশিংটন। একজন প্রাক্তন ভারতীয় কূটনীতিকের সাম্প্রতিক দাবি এই ধারণাগুলোকে সমর্থন করে এবং ভাবতে বলে যে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রভাবে বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগের মাত্রা নির্ধারণ করে। এই বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
ডোনাল্ড লু: আমেরিকা বাংলাদেশে তার স্বার্থকে আমেরিকার স্বার্থের লেন্স দিয়েই দেখে। আমরা এটাকে চীনের স্বার্থ বা ভারতের স্বার্থ বা রাশিয়ার স্বার্থের লেন্স দিয়ে দেখি না। আমাদের এখানে গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রয়েছে এবং আমরা আমাদের বাংলাদেশি বন্ধুদের সাথে সরাসরি আলোচনা করেছি। আমি মনে করি সেগুলো ফলপ্রসূ এবং দরকারি আলোচনা। এখন আমি বলব এটা সত্য যে আমেরিকা এবং ভারত কথা বলছে। আমরা সব সময় কথা বলছি, এবং আমরা এই অঞ্চলে, শ্রীলঙ্কায়, মালদ্বীপে, নেপালে এবং কখনো কখনো বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া জিনিসগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। আমি যা বলব, তা হলো—আমেরিকা কখনো কখনো ভারতীয় নীতিকে প্রভাবিত করে এবং কখনো কখনো ভারত আমেরিকান নীতিকে প্রভাবিত করে। এটাকেই আমরা কূটনীতি বলি। আমরা এই অঞ্চলের সমস্ত দেশের সাথে এটি করছি। এটা পুরোপুরি স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা আমেরিকান মূল্যবোধ এবং আমেরিকান অগ্রাধিকারের মাধ্যমেই আমাদের স্বার্থ দেখি।
নাফিজা: আপনি চীনের কথা বলছেন। তাই চীন সম্পর্কে একটি প্রশ্ন আছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়াসহ সারা বিশ্বে চীনের প্রভাব বাড়ছে। মালদ্বীপের সাম্প্রতিক নির্বাচনে যেমন ঘটল, তা একে সমর্থন করে। বা বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের (বিআরআই) সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের পর চীন এখন বাংলাদেশের সাথে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) এবং গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ (জিএসআই) স্বাক্ষর করতে আগ্রহী। এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাবকে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে দেখে?
ডোনাল্ড লু: আমরা সবসময় আমাদের অংশীদারদের বলি, আমরা আপনাকে নির্বাচন করতে বলি না। আমরা চাই চীনসহ আপনি যে সমস্ত দেশের সাথে যোগাযোগ করেন, তাদের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক রাখুন। কিন্তু আমরা এটাও চাই যে, আপনি স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখুন। এমন সম্পর্ক রাখুন, যেন তা জোরপূর্বক বা চাপ বা অস্বাভাবিক ঋণের শর্ত দ্বারা সংজ্ঞায়িত না হয়। আমি কিরগিজস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলাম। কেউ সেখানে বিনিয়োগের জন্য প্রতিযোগিতা করেনি। কিরগিজ প্রজাতন্ত্রে শুধু চীনই বিনিয়োগ করছে। তারা কিছু খুব খারাপ প্রকল্প করেছে, বিশাল, ব্যয়বহুল প্রকল্প, যার কোনো গন্তব্য নেই। পাশেই কাজাখস্তানে পশ্চিমা দেশ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র—আমরা সবাই প্রতিযোগিতা করছিলাম। কাজাখস্তানের এক নম্বর বিনিয়োগকারী হল্যান্ড। দুই নম্বরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আট নম্বরে রয়েছে চীন। এবং চীন যখন আট নম্বরে থাকে, তখন চীন স্বাভাবিকভাবে প্রতিযোগিতা করে। তখন সেখানে সাধারণ মাত্রার ঋণ থাকে। সেখানকার প্রকল্পগুলোয় সাধারণ কাজাখ লোকেরা কাজ করে, চীনারা নয়। আমি শুধু বলার চেষ্টা করছি, আমরা চাই চীন বাংলাদেশের ভালো অংশীদার হোক। এটি ঘটতে, আমাদের বিনিয়োগের জন্য প্রতিযোগিতা, প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের জন্য প্রতিযোগিতা, ধারণার জন্য প্রতিযোগিতা, শিক্ষার জন্য প্রতিযোগিতা করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়।
পরিবেশমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের চমৎকার আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের পরিবেশ, যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ উন্নত করতে আমাদের দুই দেশের মধ্যে অনেক কিছু করার আছে। আপনি কীভাবে উপকূল ব্যবস্থাপনা করছেন, কীভাবে এই দেশে চরম তাপ ব্যবস্থাপনা করছেন, আপনার বন ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি থেকে আমাদের শেখার আছে।
নাফিজা: বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে আপনার সাম্প্রতিক যোগাযোগে আপনি অংশীদারির ভিত্তিতে অগ্রাধিকার ঠিক করার কথা বলেছেন। সেই আলোচনাগুলো সম্পর্কে আপনি আমাদের জানাবেন যে, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পরবর্তী পর্যায়কে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ডোনাল্ড লু: নির্বাচন সম্পর্কিত নানা বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে একটি কঠিন বছর পার করার পর এই সপ্তাহে আমাদের প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফরের উদ্দেশ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে আস্থা পুনঃস্থাপন করা। আমরা দেখাতে চাই যে আমরা পেছনে নয়, সামনের দিকে তাকাতে প্রস্তুত। এমন একটি সম্পর্ককে নবায়ন করতে, যেখানে রয়েছে অনেক কঠিন সমস্যা মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ। আমরা এটা নিয়ে সিরিয়াস। আমরা মানবাধিকার বা দুর্নীতি বিরোধী অবস্থান বা আমরা যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলি তার কোনোটিই ছেড়ে দিচ্ছি না। তবে আমাদের ভারসাম্যও থাকতে হবে। একযোগে কাজ করার ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে ইতিবাচক বিষয়াদি থাকতে হবে। আমি আজ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছি। অনেক ইতিবাচক উদ্যোগ সম্পর্কে কথা বলেছি, যা আমরা বাংলাদেশি ও আমেরিকান জনগণের জীবনকে উন্নত করতে গ্রহণ করতে পারি। তারা এমন অনেক বিষয় সম্পর্কিত তালিকা দিয়েছে, যা আমরা একসাথে করতে পারি। এটা খুবই দারুণ উদ্যোগ। এটি আমাকে ভবিষ্যতের জন্য খুব আশাবাদী করে তুলেছে।
নাফিজা: ৫০ বা ১০০ বছর বা তারও বেশি সময়ের জন্য কাজ করার পরিকল্পনা…
ডোনাল্ড লু: আপনি জানেন, পরিবেশমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের চমৎকার আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের পরিবেশ, যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ উন্নত করতে আমাদের দুই দেশের মধ্যে অনেক কিছু করার আছে। আপনি কীভাবে উপকূল ব্যবস্থাপনা করছেন, কীভাবে এই দেশে চরম তাপ ব্যবস্থাপনা করছেন, আপনার বন ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি থেকে আমাদের শেখার আছে। একইভাবে আমরা এখানে সহায়ক হতে চাই। আমরা আমেরিকান প্রযুক্তি, আমেরিকান সক্ষমতা আনতে চাই, যা আপনাকে এই অবিশ্বাস্য লড়াইগুলোতে সাহায্য করতে পারে।
নাফিজা: মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও প্রতিরোধ বাহিনীর মধ্যে চলমান সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র রাখাইন ও কক্সবাজারের পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করে? বিশেষ করে মানব পাচার, মাদক পাচার এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কী? এর প্রভাব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং এর বাসিন্দাদের শান্তি ও নিরাপত্তায় কীভাবে পড়ছে?
ডোনাল্ড লু: আচ্ছা, প্রথমেই বলে রাখি আমি গত বছর কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। সেই অভিজ্ঞতা সত্যিই আমাকে প্রভাবিত করেছে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির। আমি বাংলাদেশি জনগণের উদারতা ও সহানুভূতি দ্বারা অনুপ্রাণিত। আপনি আপনার দেশে এক মিলিয়ন মানুষকে স্বাগত জানিয়েছেন। এটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য বোঝা। আমরা সেই বোঝা ভাগ করে নিতে চাই। যুক্তরাষ্ট্র হলো সবচেয়ে বড় একক দাতা, যারা শুধু উদ্বাস্তুদেরই সহায়তা প্রদান করে না, শরণার্থীদের প্রতিবেশী বাংলাদেশি পরিবারগুলোকেও সহায়তা দেয়। আমরা সেই সহায়তা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি তা বাড়াতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই অঞ্চলের সকল মানুষ, উদ্বাস্তু ও বাংলাদেশি পরিবারগুলো যাতে স্বাভাবিক, সুস্থ ও নিরাপদ জীবনযাপন করতে পারে, তা নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য। অন্যান্য দাতারা যথেষ্ট অর্থ দিচ্ছে না। এ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। তাই আমরা আজ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র সচিবের সাথে কথা বলেছি, কীভাবে আমরা একসাথে কাজ করতে পারি। বাংলাদেশ সরকার, আমাদের সরকার, একসাথে বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় যেতে পারে এবং এই গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টায় অবদান রাখতে অনুরোধ করতে পারে। রাখাইনে চলা সহিংসতা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। আমি দেখতে পাচ্ছি মিয়ানমারে এখন কী ভয়ংকর অবস্থা বিরাজ করছে! আমার মনে হয়, মানুষের পক্ষে নিরাপদ পরিস্থিতিতে ফেরা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ এবং আমরা সবাই যারা জাতিসংঘ পরিবারের অংশ, তারা শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করছি। ততক্ষণ পর্যন্ত, আমরা বাংলাদেশকে ধৈর্য ধরতে এবং এই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জনগুোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে বলছি। শিবিরের ভেতরে শরণার্থীদের অর্থোপার্জনের ব্যবস্থা করে, অন্যান্য পরিষেবা, বা হস্তশিল্প বা অন্য কোনোভাবে আয়ের পথ খুলে দিয়ে তাদের জীবনমান উন্নত করা যায় কিনা, সে বিষয়ে আমাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। তারা যে তাঁবুতে বাস করে, সে সম্পর্কেও আমরা কথা বলেছি যে, কীভাবে এসব তাঁবুকে বর্ষা মৌসুমের জন্য আরও নিরাপদ ও টেকসই করা যায়? এই শরণার্থীদের জন্য সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকারকে আমরা দেখছি। উদ্বাস্তুদের জন্য তাঁরা যা করছেন, তার জন্য আমরা তাঁর এবং বাংলাদেশি জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞ।
নাফিজা: (ফুচকা খাওয়াকে ইঙ্গিত করে) গত পরশু খেয়েছেন?
ডোনাল্ড লু: হ্যাঁ।
নাফিজা: স্বাদ কেমন?
ডোনাল্ড লু: এটি আমার প্রথম ফুচকা খাওয়ার অভিজ্ঞতা। সুস্বাদু। অ্যাম্বাসেডর হাসের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জন্মে গেছে, যিনি ফুচকা শেফ হওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে সত্যিই সেই সেলিব্রিটি শেফকে শ্রদ্ধা জানাই, যিনি আমাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। আমরা খুব ভালো ছাত্র ছিলাম না। তবে আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। আমি রাষ্ট্রদূত (পিটার) হাসকে বলেছি, যখন আমরা দুজনেই অবসর নেব, তখন তিনি ও আমি নিউইয়র্কের রাস্তায় ফুচকা স্ট্যান্ড দেব।
নাফিজা: বাংলাদেশে তো এ নিয়ে ষষ্ঠবার এলেন।
ডোনাল্ড লু: হ্যাঁ। আমি সত্যিই এটা উপভোগ করছি। মানুষ আমার প্রতি খুব সদয় আচরণ করেছে। সরকারের সঙ্গে, সুশীল সমাজের সঙ্গে, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সঙ্গে এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে আমাদের চমৎকার আলোচনা হয়েছে।
নাফিজা: বাংলাদেশের কোন বিষয়টিকে আপনি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন?
ডোনাল্ড লু: আমি বাংলাদেশি মানুষের মনোবলকে ভালোবাসি। রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় বা হাঁটার সময় দেখবেন, লোকেরা তাদের এই জীবনকেই দারুণভাবে গ্রহণ করেছে। আনন্দের একটা চেতনা আছে। লোকেদের পোশাক, ভবনগুলো কিংবা সবজি বা ফল বিক্রির স্ট্যান্ডগুলো—সব রঙিন। এমনটা আপনি সবখানে দেখবেন না। বিশ্বের অধিকাংশ জায়গাই ক্লান্তিকর। শুধু সিমেন্ট, আর ধূসরতা দেখবেন। আর আপনার এখানে আছে শুধু রং।
নাফিজা: এই দেশকে, ৫০ বছর পর বাংলাদেশকে কোথায় দেখতে চান?
ডোনাল্ড লু: আমি খুব আশাবাদী, যে শিশুরা আজ জন্ম নিচ্ছে, যখন তারা ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সে পৌঁছাবে, তখন তারা দেখবে যে, এটি একটি খুব সমৃদ্ধ জায়গা, যেখানে প্রত্যেকে একে অপরকে শ্রদ্ধা করে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধিও রয়েছে, যা তাদেরকে নিজের সন্তানের শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেওয়ার সুযোগ করে দেয়, যা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। আশপাশের দেশগুলোর সাথে কিংবা আমার দেশসহ অন্য দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পদ গড়তে পারে। আমি আশা করি এটা এমন এক দেশ হবে, যেখানে মানুষেরা শান্তিতে বাস করে, যেখানে গণতন্ত্র আছে, মানুষের বাকস্বাধীনতা আছে এবং তারা তাদের নেতা নির্বাচনে সক্ষম, যে নেতা সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ভবিষ্যতের পথে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
নাফিজা: ধন্যবাদ আপনাকে।
ডোনাল্ড লু: আপনাকেও ধন্যবাদ। আমি সত্যিই সময়টা উপভোগ করেছি। এটা সম্মানেরও। ধন্যবাদ।