ঘটনাটা ২০২১ সালের। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপে প্রথম পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে পাপুয়া নিউগিনির (পিএনজি) বিপক্ষে মাঠে নামার কথা টাইগারদের। আইসিসি আগের দিনই সংবাদ সম্মেলনের সময় সূচি জানিয়ে দেয়। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ ও স্থানীয় সাংবাদিকরা মাঠে আসেন।
স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে ৫টায় সংবাদ সম্মেলন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় এক ঘণ্টা পেরিয়ে যায়, কিন্তু কেউ আসেননি।
কয়েক দফা সময় পরিবর্তন করে শেষ পর্যন্ত রাত পৌনে ৮টায় বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যাটিং কোচ অ্যাশওয়েল প্রিন্স আসেন। সেই সময় কোনো সাংবাদিকই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না। এ সময় আইসিসির মিডিয়াকর্মী কালাম ডেভিস পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে বাংলাদেশ দল নিয়ে প্রিন্সকে নানা প্রশ্ন করেন। আর সেসব প্রশ্নের উত্তর দেন প্রিন্স।
ঠিক এভাবেই সংবাদ সম্মেলন বর্জন করে সমন্বয়হীনতা ও দেরি করার প্রতিবাদ করেছিলেন সাংবাদিকরা। এঘটনায় বিব্রত হতে হয়েছিল আইসিসিসহ আয়োজকদের।
তবে বাংলাদেশে এমন ঘটনা হরহামেশাই হয়। অর্থাৎ দেরিতে আয়োজকদের উপস্থিত হওয়া। তবে বারবার দেরি করলেও তাদের বোধোদয় বা টনক নড়ে না। বিশেষত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা রাজনৈতিক–অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রধান অতিথি করে আয়োজন করা কর্মসূচিতে এমনটা নিয়মিতভাবেই দেখা যায়। এক্ষেত্রে আয়োজকদের ‘খোঁড়া’ কিন্তু ‘সফল’ যুক্তি—‘রাস্তায় অনেক জ্যাম।’ বা ‘প্রধান অতিথি এখনও এসে পৌঁছাননি।’
আমাদের দেশের অনুষ্ঠানগুলো বিশেষত, সাংস্কৃতিক আয়োজনে বেশিরভাগ সময়ই প্রধান অতিথির তালিকায় থাকেন মন্ত্রীরা। তাই তাদের ব্যস্ততার বিষয়টি মাথায় রেখে অনেক সময়ই সংবাদকর্মীরা অনুরোধে দেরি হওয়ার বিষয়টি `গিলে' নেন। তবে সবাই যে এমন করেন তা নয়।
চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার, কনসার্ট থেকে শুরু করে মঞ্চ বা অন্য অনুষ্ঠান প্রায় সব খানেই এই অপেক্ষা দোলাচল। সবশেষ দেশীয় চলচ্চিত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক শাকিব খানের অনুষ্ঠানে এই সব পুরনো বিষয় আবারও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কারণ প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর ‘তুফান’ চলচ্চিত্রের শিল্পীরা আসেন। এরপরই এই সংবাদ সম্মেলন হয়ে উঠে তুফান নিয়ে অগ্নিপর্ব। একের পর এক প্রশ্নের স্ফুলিঙ্গ বেশ ভালোভাবে সামলান শাকিব খান। তবে তার বক্তব্যে বের হয়ে আসে আরও একটি নাটকীয় তথ্য।
সময় নিয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল এমন—অনুষ্ঠানগুলোতে প্রায়ই লেট হয়। কথায় কথায় বলা হয়, বাঙালি বলেই লেট হয়েছে। ওপার বাংলাতেও কি এভাবে টাইম মেনটেইন করা হয় কিনা জানতে চান ওই সাংবাদিকও।
এখানে শাকিব খান বেশ বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দেন এই বলে, ‘দেখুন, এই সংবাদ সম্মেলন বা আগের পুরনোগুলো; আমি তো রেডি-ফেডি হয়ে বসে থাকি। আমি আয়োজককে জিজ্ঞেস করি, কি যাব? যিনিও বাঙালি। তিনি বলেন, বেশ কিছু বাঙালি (সাংবাদিক) এসেছেন, আরো কিছু বাঙালি বাকি আছে। এভাবেই দেরি হয়ে যায়!’
এই উত্তরেই সূক্ষ্ম ও স্পষ্ট আরো একটি বিষয় চলে আসে তা হলো—এই দেরি করানোর সংস্কৃতিতে যুক্ত থাকেন আয়োজকরাই। এর অর্থটা কিন্তু ভয়াবহ। দেশের জরুরি পেশা হিসেবে বিবেচিত হওয়া সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমের বড় একটি অংশ (প্রতিটি সংবাদ সম্মেলনে ১০০-১২০ জন সাংবাদিক) দিনের পর দিন অকারণে বসে থাকেন। তাঁদের অন্য অনেক দায়িত্ব যেমন পালন করতে তাঁরা পারেন না; তেমনি দেরি করে অফিসে গিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়ে তাঁর বাসাতেও ফিরতে হয় দেরিতে। ব্যক্তিগত কাজেও পড়ে প্রভাব। পাশাপাশি চাপটা মানসিকও। ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে যাওয়া, পরিবারের কাছে নিজের দায়িত্ব পালন করতে না পারাও তো হতাশা তৈরি করতে পারে।
দিনে যদি এমন ১০টি ইভেন্ট হয়ে থাকে, সেগুলোর হিসাব ধরলে দেশের গণমাধ্যমের বৃহত্তর জনশক্তির কর্মক্ষমতার অপচয়টা ধাক্কা লাগার মতো। ভাবুন তো একবার। আরেকটা ক্ষতি হয়ত আমাদের অগোচরেই হয়ে যায়। সেটা—মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নৈতিকস্খলন।
সবশেষ তুফানের শিল্পী মিমির একটি বক্তব্য তুলে ধরতে চাই। সময়জ্ঞান নিয়ে তিনি সেই সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সময় পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জিনিস। আপনি যে সময়টা, ক্ষণটাতে আমাকে প্রশ্ন করেছেন, সেটা জীবনে কোনো দিন পাব না। আমি ও আপনি কখনও ফিরে পাব না। শত চেষ্টা করলেও সম্ভব নয়। এটা পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান।’
তাই নয় কি?
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক, ইনডিপেনডেন্ট ডিজিটাল
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]