একটা উন্নয়নশীল দেশে সমস্যার কি শেষ আছে। যেখানে অনেক বড় বড় সমস্যারই কোনো কূল-কিনারা পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে ছোটখাট সমস্যা নিয়ে কথা বলার কি কোনো সুযোগ আছে। কিন্তু আমার কাছে সমস্যাটা খুব ছোট বলে মনে হয় না। এ কথা সত্যি, অনেক সময় হকার সমস্যা একটা উৎপাত বলে মনে হয়। কেননা যেকোনো দেশেই ফুটপাত রাখা হয় মানুষের হাঁটার জন্য। দোকানের পসরা বসিয়ে সেটা বন্ধ করে দিলে সাধারণ মানুষের বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। মানুষ তখন বাধ্য হয়ে গাড়ি চলাচলের রাস্তা ব্যবহার করে। ফলে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। অনেক সময় দুর্ঘটনাও ঘটে।
এমনিতেই বাংলাদেশ একটা বিপুল জনসংখ্যার দেশ। এর ওপর বড় শহরগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। এখানে আবার যদি ফুটপাত এভাবে বন্ধ হয়, তাহলে অবশ্যই এটা একটা সমস্যা।
আমাদের সিটি করপোরেশন কর্তাব্যক্তিদের ভাবখানাও তাই। কোনোভাবেই তারা হকারের উৎপাত সহ্য করতে রাজি না। প্রায়ই দেখা যায় তারা তেড়ে আসেন। সাথে থাকে ডজনখানেক টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা। মাইক এগিয়ে দিতেই কর্তারা অগ্নিশর্মা হয়ে তাদের শাসিয়ে দেন এই ধরনের কাজ এখন থেকে আর সহ্য করা হবে না। আর তাদের ছোটখাটো টিনশেডের কোনো দোকান থাকলে তা গুঁড়িয়ে দিয়ে চলে যান। বাহবা পান সব মহল থেকে। যেন তিনি এক মহান কাজের কারিগর। দেশ তো এদেরকেই চায়।
মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে সেই হকার নামের প্রাণীগুলো। প্রাণী বললাম, কেননা তাদের আমরা নাগরিক মনে করি না। আবার আমরা যেমন মনে করি ওদের এই ব্যবসা করতে কোনো টাকা পয়সা লাগে না—এমনটাও কিন্তু না। তাহলে ওরা আর ব্যবসা করতে পারত না। পদে পদে ওদের হাদিয়া দিতে হয় বিভিন্ন পক্ষকে। চাঁদা না বলাই ভালো। কারণ, শব্দটা একটু আপত্তিকর যারা এসব আদায় করে থাকেন, তাঁদের জন্য। তাঁরা সমাজের উঁচু শ্রেণির লোক। যেমন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ অথবা তাদের নিয়োজিত হাদিয়া আদায়কারী লোকলস্কর বা এলাকার সন্ত্রাসী চক্র। আইন‑শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নিয়মিত হাদিয়া পেয়ে থাকে বলে অভিযোগ আছে। অতএব তারাও চায় যে হকার থাকুক। কারণ, হকার মানে হকার না, হকার মানে হাদিয়া। অবশ্য মাঝে মাঝে তারা ফিরে আসে। অসহায় মানুষগুলো ওদের পণ্য গুটিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। কেউ কেউ ধরা পড়ে। পুলিশের গাড়িতে তোলা হয় তাদের। পরে যথাযোগ্য সম্মানী দিয়ে রেহাই মেলে।
কিন্তু এই মানুষগুলো কারা? এরা কী চোর ডাকাত, সন্ত্রাসী? কী করছে ওরা? ওরা কি দেশের বা সমাজের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজের সাথে জড়িত? উত্তর হচ্ছে, কখনোই না। সকাল থেকে সন্ধ্যা রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে ওরা ওদের পরিবারের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের জন্য নিরন্তর সংগ্রামে লিপ্ত। ওরা যে জিনিসপত্র বিক্রি করে, ওগুলো সাধারণত মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তদের চাহিদা পূরণ করে। সস্তা পণ্য ওই শ্রেণির মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটায়।
দেখা যাচ্ছে, এটা একটা বিশাল বাজার। আর এর সাথে জড়িত বিশালসংখ্যক মানুষের জীবন‑জীবিকা। তারা যে জিনিস বিক্রি করে, তা তৈরি হয় অসংখ্য ছোট ছোট কারখানায়। ফলে কর্মসংস্থান হচ্ছে প্রচুর মানুষের। কথা হলো, তাহলে কি হকারদের এভাবে ব্যবসা করাটা মেনে নিতে হবে? যারা পথচারী, তাদেরও তো অধিকার আছে রাস্তায় ঝুঁকিমুক্ত চলাচলের। তাহলে সমাধানটা কী? সমাধানটা এ রকম যে, সাপও মরবে আবার আমার লাঠিও ভাঙবে না। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা আর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের।
প্রথমে বড় শহর ঢাকা ও চট্টগ্রামে জরিপ চালিয়ে দেখতে হবে কী পরিমাণ লোক এর সাথে জড়িত। তারা কী কী পণ্য বিক্রি করে? গ্রামীণ ব্যাংক যেভাবে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে লোকদের স্বাবলম্বী করে, সে রকম কোনো ব্যবস্থা হতে পারে আবার সমবায়ের মাধ্যমেও হতে পারে। কীভাবে ভালো হবে–এটা একটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু এই ব্যবসাটায় সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে এটার একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। এর মাধ্যমে এদের অর্থায়ন, বিপণন পণ্যের মানোন্নয়ন ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত হবে। তাহলে ব্যক্তিগতভাবে তাদের অবৈধভাবে ব্যবসার প্রয়োজন হবে না। দ্বিতীয়ত, ফুটপাত শুধু মানুষের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। তাহলে হকারদের জায়গা হবে কোথায়? অনেকভাবে এটা হতে পারে যেমন নিদিষ্ট সময় অথবা নিদিষ্ট জায়গা নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। করা যাবে, এটা নিশ্চিত। তবে ঠিক কীভাবে করা যাবে, তা মূলত গবেষণার বিষয়।
এ কথা এ জন্য এখন বলছি কেন? কারণ, যার কারণে বাংলাদেশ বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছে, সেই ক্ষুদ্রঋণের কারিগর এখন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান। তিনি স্বল্পমেয়াদে অন্তত পক্ষে এর একটা ভিত্তি রচনা করে যেতে পারেন, যা পরে ধীরে ধীরে বিকশিত হবে। এর ফলে আরও বেশিসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান হবে, দেশজ উৎপাদন বাড়বে, মানুষ চলাচলে স্বস্তি পাবে।
বাংলাদেশে এখন সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে বেকারত্ব। এই হকারদের একটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার আওতায় এনে যদি এদের আর্থ‑সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করা যায়, তবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে অনেক দূর। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়–বাংলাদেশের যদি প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নতি ও প্রগতি নির্ভর করে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির মধ্যে। তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের উন্নতি নিশ্চিতভাবে দেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করবে। বর্তমান সরকারের কাছে প্রত্যাশা–এই হতভাগ্য হকারদের প্রতি যেন সুদৃষ্টি দেওয়া হয়। আশা করি এর ফলে বাংলাদেশ এক নতুন যুগে প্রবেশ করবে।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]