আমাদের দেশের সমষ্টিগত মানুষের কথা দিয়েই শুরু করছি। কিন্তু সমষ্টি তো ব্যক্তি নিয়েই গঠিত। মুক্তিযুদ্ধের পরে দেখা গেল ব্যক্তি ব্যস্ত হয়ে গেছে, সে কী পেয়েছে তার হিসাব নিতে। এই বোধের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো সঙ্গতি নেই, বরঞ্চ এ হচ্ছে ওই চেতনার সম্পূর্ণ বিরোধী। কেননা এটা ভিক্ষুকের মনোভাব, যোদ্ধার নয়। যোদ্ধারা সকলের স্বার্থ দেখে, ভিখিরি দেখে নিজের স্বার্থ। যুদ্ধে বিজয়ের পর দেখা গেল মানুষ ভিখিরি হয়ে যাচ্ছে। বিদেশি সাহায্য ছাড়া আমাদের চলবে না–এ বোধটা যোদ্ধাদের বোধ নয়। ওই মনোভাব থাকলে যুদ্ধ হতো না, যারা ওই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যুদ্ধে গেছে তারা প্রকৃত যোদ্ধা ছিল না। বিদেশি সাহায্যের লালসা প্রবল হলো, সঙ্গে থাকল ব্যক্তিগত লাভের লিপ্সা। দুটি অবশ্য ভিন্ন বস্তু নয়, একই তারা।
সত্য এটাও যে, এই ভোগবাদিতা মৌলবাদকে উৎসাহিত করেছে। আর বঞ্চিত মানুষ দেখেছে সব সুখ কিছু লোক নিয়ে নিচ্ছে; এবং বঞ্চনার এই বোধ থেকে তারা ধর্মের কাছে গেছে, গিয়ে প্রকাশ্যে যারা ভোগবাদী তাদের তুলনায় নিজেদেরকে উচ্চজ্ঞান করবার সুযোগ পেয়েছে।
মৌলবাদ আজকের বাংলাদেশে মস্ত বড় সমস্যা। এর বিকাশে আরও যেসব উপাদান কার্যকর রয়েছে, তাদের একটি হচ্ছে ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা। এ কাজ ধর্মব্যবসায়ীরা তো করছেই, জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া দলও করছে। মৌলবাদের পেছনে আরেকটি কারণ মানুষের আশ্রয়হীনতা। রাষ্ট্র তার মিত্র নয়। নিরাশ্রয় মানুষ ধর্মের কাছে যায় আশ্রয় ও বিচারের প্রত্যাশায়। আশ্রয় জিনিসটা যে কত দরকার, তার একটি প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল রুশ দেশের জাতীয় সংগীতের পরিবর্তনে প্রতিফলিত মনোভঙ্গিতে। সোভিয়েত ইউনিয়ন একদা যে গানকে জাতীয় সংগীত করেছিল, সোভিয়েতের পতনের পর তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়; কিন্তু মানুষ ওই গান ভোলেনি। ওই গানে আশ্রয়ের কথা ছিল, জনগণের পার্টি জনগণকে আশ্রয় দেবে–ছিল এই কথা। নতুন গান তৈরি করা হয়েছিল, কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, তাই পুরাতন গানের সুরটিকে ফেরত আনা হয়েছে, কথাগুলো বদলে। আগে যেখানে ভরসা করা হয়েছিল পার্টির ওপর, এখন সেখানে ভরসা করা হচ্ছে ঈশ্বরের ওপর। ওই রকমই বটে, আশ্রয় দরকার হয়, এবং সে আশ্রয় ইহজাগতিক সংগঠনের কাছে না পেলে পারলৌকিক ঈশ্বরের কাছে যেতে হয়। মৌলবাদের তৎপরতার পেছনে এই হারানো এবং প্রাপ্তির ব্যাপারের কার্যকর ভূমিকাকে যেন না ভুলি।
যুদ্ধ কোথায় নেই? নানা ধরনের দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ, কলহ সর্বদা চলছে। সর্বত্র চলছে। আছে গৃহে, রয়েছে সমাজে। মানুষ বাঁচার জন্য লড়ছে। এ কালের মূল যুদ্ধটা রাজনৈতিক। রাজনীতির ক্ষেত্রে অনেককাল ধরে ওই দুই ধারা ছিল, একটি ভিক্ষার, অপরটি যুদ্ধের। ভিক্ষার রাজনীতি আবেদন-নিবেদনের, যুদ্ধের রাজনীতি আন্দোলনের। ব্রিটিশ আমলে শাসকশ্রেণি আবেদন-নিবেদনের ব্যাপারটাকে উৎসাহিত করেছে, তারা করুণা করতে চেয়েছে; কিন্তু অধিকার দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে জনগণের আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠেছিল; রাষ্ট্রক্ষমতা পাছে আন্দোলনকারীরা ছিনিয়ে নেয়, সেই আশঙ্কায় তারা ক্ষমতা তুলে দিয়ে গেছে আবেদন-নিবেদনকারীদের হাতে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই পূর্ববঙ্গে প্রধান রাজনৈতিক ঘটনা হলো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। তার অঙ্গীকারটি ভিক্ষার ছিল না, ছিল যুদ্ধের; যে-জন্য ওই আন্দোলনে বিভ্রান্তি আসেনি, তাকে বিভক্ত করা সম্ভব হয়নি। সে থেমে যায়নি মাঝপথে, এবং পরিণতিতে প্রতিষ্ঠা করেছে স্বাধীন বাংলাদেশের। কিন্তু আপসের প্রস্তাব যে আসেনি, তা তো নয়; এসেছে, এবং এসেছে একেবারে শুরুতেই। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে সরকার কর্তৃক তড়িঘড়ি জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করা হবে কি হবে না–এই ঐতিহাসিক প্রশ্নে ক্ষমতালব্ধ রাজনৈতিক নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভঙ্গ না-করার। তারা ভয় পেয়েছে আন্দোলন চলে যাবে তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, গোলযোগ বাধবে, ফলে সরকার নির্বাচন দেবে পিছিয়ে এবং নির্বাচন পিছিয়ে দিলে তাদের পক্ষে ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারটা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ভিক্ষুকদের কথা, সন্দেহ কী! কিন্তু যোদ্ধারা শোনেনি। তারা এগিয়ে গেছে, এবং ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়, এবং পরে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নয়, যুদ্ধের মধ্য দিয়েই দেশকে স্বাধীন করেছে।
সত্তরে নির্বাচন হয়েছে, একাত্তরে যুদ্ধ। সাতচল্লিশে ব্রিটিশ শাসকেরা যা করতে পেরেছিল একাত্তরে পাকিস্তানি শাসকেরা তা করতে পারেনি; অর্থাৎ, পারেনি যোদ্ধাদের হঠিয়ে দিয়ে আপসপন্থীদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে দিয়ে প্রস্থান করতে। তবে ওই শাসকদের মুরব্বি যারা, সেই সাম্রাজ্যবাদীরা, তৎপর হয়ে উঠেছে যুদ্ধকে যত শিগগিরই পারা যায় থামিয়ে দিতে, যুদ্ধের নেতৃত্ব যাতে বামপন্থীদের হাতে চলে না যায় এবং বাংলাদেশ যাতে নতুন একটি ভিয়েতনামে পরিণত না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে। তারপরের ইতিহাস তো আমরা জানিই। যোদ্ধাদেরকে উৎসাহিত করা হয়েছে ভিক্ষুকে পরিণত হতে।
সাম্রাজ্যবাদীরা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধকে সমর্থন করেনি; তাদের আশঙ্কা ছিল এই রাষ্ট্র তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না, চলে যাবে সমাজতন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণে। রাষ্ট্রের আদি সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের যে লক্ষ্য চিহ্নিত ছিল, সেটা হচ্ছে সমাজতন্ত্র, যার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা তো রয়েছেই, প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতিও বিদ্যমান। যুদ্ধ শুরু হোক, সাম্রাজ্যবাদীরা এটা চায়নি; শুরু হবার পর চেয়েছে দ্রুত থেমে যাক এবং থেমে গেছেও। তারপরে তারা শাসকদেরকে টেনে নিয়েছে কোলে। রাষ্ট্র চলে গেছে সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণে। বাংলাদেশ এখন একটি তাঁবেদার রাষ্ট্র। তার মৌলিক সিদ্ধান্তগুলো ঢাকায় নেওয়া হয় না, নেওয়া হয় অন্যত্র। আমলাতন্ত্র সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণে, এনজিওরাও তা-ই। মাটির নিচে তেল-গ্যাসের খোঁজ পাওয়া গেছে, সাম্রাজ্যবাদীরা চাচ্ছে সেটা গ্রাস করতে। সরকার ও বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো কেউই এ ব্যাপারে অসম্মত নয়। তারা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, কিন্তু তারা যোদ্ধাদের দল নয়, দল বিপরীত ধরনের মানুষদের। এরা দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি চায় না, চায় নিজেদের থলি ভরপুর করতে। রাষ্ট্রকে নিয়ে গেছে এমন জায়গায় যে, ভিক্ষা ছাড়া তার চলে না।
কিন্তু তবু যুদ্ধ তো চলছে। তথাকথিত জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলো যা দেওয়ার ইতিমধ্যে দিয়ে ফেলেছে, তারা আর কিছু দেবে না, রাষ্ট্রের জন্য সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীলতা এবং জনগণের জন্য অর্থনৈতিক বৈষম্য ছাড়া। এরা পুঁজিবাদকে বিকশিত করছে, যে পুঁজিবাদ মানুষের মুক্তি আনবে না, আনলে আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ভেঙে বাঙালিকে বের হয়ে আসতে হতো না। জাতীয়তাবাদী বলে কথিত রাজনৈতিক দল চায় না যে, রাজনৈতিক যুদ্ধটা চলুক, কেননা এ যুদ্ধ তাদের বিরুদ্ধেই।
মুক্তির ওই যুদ্ধকে আসলে দমন করাই হচ্ছে। দমনের কাজটা নীরবে চলছে; কেননা যুদ্ধটা প্রবল হয়নি। প্রবল হলেই নিপীড়ন প্রত্যক্ষ হয়ে উঠবে। যুদ্ধটা অবশ্যই বাম ধারার; না হয়ে উপায় নেই। এ ধারার খবর টেলিভিশন ও রেডিওতে আসে না, প্রশ্নই ওঠে না আসবার। টেলিভিশন ও রেডিও সরকারি প্রচারযন্ত্র ভিন্ন অন্য কিছু নয়। সংবাদপত্রেও এই আন্দোলনের খবর আসে না। উল্টো খবর দেওয়া হয়, বিভ্রান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে; কেননা সংবাদপত্রের মালিকেরা ভিক্ষুক চায়, যোদ্ধা চায় না।
বিক্ষিপ্তভাবে আন্দোলন চলছে। প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। সেই সংগ্রাম হবে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। এ আন্দোলন যে জোরদার হচ্ছে না, তাতে আনন্দিত হবার কোনো কারণ নেই; বরঞ্চ কারণ আছে দুঃখিত হবার। একাত্তরের যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে গেলে আমাদের জন্য তা যেমন ভয়ঙ্কর ব্যাপার হতো, মুক্তির চলমান যুদ্ধে ব্যর্থতাও তেমনি বিপজ্জনক হবে। ভিক্ষা আর যাই হোক মুক্তির পথ নয়।
সামনে যেতে হলে ঐক্য দরকার হবে, সাধারণ ও চিহ্নিত শত্রুর বিরুদ্ধে। স্বর্গ যদি কোথাও থেকে থাকে তবে আছে ওই মৈত্রীতে, তার বাইরে কোথাও নেই। বাইরে কেবল সংঘর্ষ ও একাকিত্ব, কেবলি নত হওয়া; বলা চলে নরকবাস। যা নিশ্চয়ই আমরা চাইব না।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]