‘ধান বুনলে পণের রাশি, তবেই তাহার ফলের আশা’
– খনা
বাংলায় কৃষির ইতিহাসে খনার নামটি এক অবিচ্ছেদ্য চিহ্ন। তিনি ছিলেন নারী, ছিলেন জ্ঞানী, ছিলেন কৃষিভিত্তিক জ্ঞানের বাহক–যার বচন আজও কৃষকের মুখে মুখে ফেরে। খনার বচনের মাধ্যমে আমরা বুঝি, প্রাচীনকাল থেকেই নারীরা শুধু কৃষিকাজে অংশ নেননি, তাঁরা কৃষি জ্ঞানের ধারক ও বাহক ছিলেন। অথচ যুগ যুগ ধরে তাঁদের ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় উপেক্ষিত থেকেছে, নীতিনির্ধারণে উপেক্ষিত থেকেছে, এমনকি নিজ পরিবারেও তাঁদের শ্রমকে ‘সহায়তা’ হিসেবে দেখা হয়েছে, ‘কর্ম’ হিসেবে নয়।
বাংলাদেশের কৃষি খাতের সাম্প্রতিক চিত্র এক নতুন বাস্তবতার কথা বলে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, বর্তমানে কৃষি খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৮৪ লাখ ৩০ হাজার, যা কৃষি খাতের মোট শ্রমশক্তির ৫৮ শতাংশ। অর্থাৎ, এ খাতে এখন পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ বেশি–যা এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
এটি কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার নতুন অধ্যায়ের নির্দেশক। ঐতিহাসিকভাবে কৃষির সঙ্গে নারীর সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন। ঘরকন্নার কাজের পাশাপাশি চাষাবাদ, বীজ বোনা, ফসল তোলা, গবাদি পশুর পরিচর্যা, পোলট্রি ও মৎস্য খাতেও নারীর নীরব কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বরাবরই। তবে সমাজ ও নীতিনির্ধারকদের চোখে এসব কাজের স্বীকৃতি তেমন ছিল না। ব্রিটিশ শাসনামলে বা তারও আগে জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনীর ভয়ে যারা মাঠে নামতে পারেনি, সেই পুরুষদের পাশে সাহস করে নারীই হাঁটু পানিতে নেমে ধান রোপণ করেছে। পাকিস্তান আমলে খাদ্য সংকটে যারা বীজ রক্ষা করেছে, তারা নারী। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে সহায়ক বীজ সংরক্ষণ, গবাদিপশু পালন, হাঁস-মুরগির খামার ও বাগান পরিচর্যায় নারীর অংশগ্রহণ ছিল অব্যাহত।
এখনকার সময়ে এসে নারীর এই ঐতিহাসিক ভূমিকা আরও সুসংগঠিত হয়েছে। আজকের এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করছে, কৃষিতে নারীর শ্রম অবদান এখন আর অদৃশ্য নয়; তা এখন সংখ্যায়, বাস্তবতায় ও প্রয়োজনে দৃশ্যমান। বিবিএস শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব নারীদের মধ্যে ২৬.২ শতাংশ এখন কৃষি ও এর উপখাতে (যেমন হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু, মৎস্য ও উদ্যানতাত্ত্বিক চাষাবাদ) কর্মরত, যেখানে পুরুষের অংশগ্রহণ ১৯.২ শতাংশ। এই ব্যবধান নারী নেতৃত্ব ও ভূমিকা বৃদ্ধির স্পষ্ট সাক্ষ্য।
অন্যদিকে, গার্মেন্টস ও সেবা খাতেও নারীর অবদান অনস্বীকার্য। পোশাক শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের অন্যতম ভিত্তি। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৬০-৬৫ শতাংশই নারী। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ক্ষেত্রেও নারীর এগিয়ে আসা আমাদের অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলেছে।
তবে এই অগ্রগতির পেছনে রয়েছে একাধিক চ্যালেঞ্জ। নারী শ্রমিকেরা এখনও শ্রমের প্রকৃত মজুরি থেকে বঞ্চিত হন, সুরক্ষা ও সুযোগের অভাব রয়েছে এবং তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ সীমিত। বিশেষত, কৃষি খাতে এত বড় ভূমিকা রাখার পরও নারীরা ভূমির মালিকানা বা সম্পত্তির সমান অধিকারে এখনও পিছিয়ে। যেখানে একজন নারী দিনের পর দিন মাটি চষে ফসল ফলান, সেখানে সেই জমির মালিক হিসেবে তাঁর নাম থাকে না–এটা এক গভীর কাঠামোগত সামাজিক বৈষম্য।
প্রয়োজন একটি সমন্বিত ও অধিকতর নারীবান্ধব নীতি কাঠামো, যা নারী শ্রমিকদের অধিকার, সম্মান ও অর্থনৈতিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করবে। নারীর জমির মালিকানা, কৃষি উপকরণে প্রবেশাধিকার, সহজ ঋণ ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটানো জরুরি, যাতে নারীর শ্রম শুধু ‘সহায়তা’ হিসেবে নয়, বরং ‘প্রধান শক্তি’ হিসেবে বিবেচিত হয়।
নারী যখন মাঠে-ঘাটে, কলকারখানায় কিংবা স্বাস্থ্য সেবায় দেশের জন্য কাজ করছে, তখন সমাজ ও রাষ্ট্রকেও তার পাশে দাঁড়াতে হবে। নীতিনির্ধারকদের উচিত, খনার উত্তরসূরিদের আর শুধু শ্রমিক হিসেবে নয়, এই দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও ইতিহাস গঠনের সমান অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। কারণ, কৃষি হোক বা গার্মেন্টস, নারী শ্রমিকেরা এখন শুধু উৎপাদনের বাহক নন, তাঁরা পরিবর্তনের নেতা।
লেখক: অধিকারভিত্তিক উন্নয়নকর্মী
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]