ইসরায়েল-ইরান সংঘাত চতুর্থ দিনে পড়েছে। উভয় পক্ষে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। ইরানে কমপক্ষে ৮০ জন এবং ইসরায়েলে কমপক্ষে ১০ জন নিহত হয়েছে। ইরানের মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন, ইরানের বিভিন্ন পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালানোর দরকার ছিল।
ইসরায়েলি জনগণের কাছে বেশ কিছু যুক্তি প্রচার করা হয়েছে। তবে এর কোনোটিই ইসরায়েল সরকার কেন এই একতরফা, বিনা প্ররোচনায় হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার আসল কারণ ব্যাখ্যা করেনি।
ইসরায়েল সরকারের দাবি, এই হামলা ছিল একটি ‘প্রতিরোধমূলক’ ব্যবস্থা। এর উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরির একটি আসন্ন, অনিবার্য হুমকি ঠেকানো। এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ আছে বলে মনে হচ্ছে না। ইসরায়েলের হামলা নিঃসন্দেহে দীর্ঘ সময় ধরে সূক্ষ্ম পরিকল্পনার ফল। একটি প্রতিরোধমূলক আক্রমণে আত্মরক্ষার একটি উপাদান থাকতে হবে, যা ঘুরেফিরে একটি জরুরি অবস্থা দ্বারা সৃষ্ট হয়। এমন কোনো জরুরি কিছু ঘটেছে বলে মনে হয় না।
এ ছাড়া ইসরায়েল ইঙ্গিত দিয়েছে, গত ১২ জুন প্রকাশিত আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রতিবেদন এমন একটি জরুরি অবস্থা তৈরি করেছে। সংস্থাটি ২০০০ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ চুক্তি (এসপিটি) সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের জন্য ইরানের নিন্দা করেছে। তবে আইএইএ ইসরায়েলের সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে বলে মনে হয়। কারণ প্রতিবেদনে এমন কিছু ছিল না, যা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কাছে ইতিমধ্যেই অজানা ছিল।
ইসরায়েল সরকার ‘প্রতিরোধমূলক’ হামলার ধারণার সাথে সরাসরি সম্পর্ক রেখে আরও বলেছে, এর লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ‘মাথা কেটে ফেলা’। বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সাধারণত এই বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে যে, ইসরায়েলের একার পক্ষে এই কর্মসূচি ধ্বংস করার ক্ষমতা নেই। বিশেষ করে যদি তারা এটি নিজে থেকেই চালানোর চেষ্টা করে।
প্রচারের প্রকৃতি যেমনভাবে উন্মোচিত হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে ইসরায়েল কখনোই ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলতে চায়নি। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি থেকে শুরু করে গ্যাসক্ষেত্র, তেলের ডিপো পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে বোমা হামলা চালিয়েছে। ইরানের জ্যেষ্ঠ সামরিক নেতাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক গুপ্তহত্যাও চালিয়েছে। আলী শামখানি একজন প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা। তিনিও টার্গেট ছিলেন এবং নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। যদিও ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ও সরকার এখনো তাঁর মৃত্যু আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেনি। শামখানি গত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনায় একজন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব ছিলেন বলে মনে করা হয়।
শামখানির হত্যাকাণ্ড, অন্যদের হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি ইসরায়েলের একটি প্রিয় পন্থাকে প্রতিফলিত করে। ইসরায়েল প্রায়শই নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের ‘নির্মূল’ করার চেষ্টা করে এই আশায় যে, তাদের মৃত্যু তাদের নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর পতন ঘটাবে। শামখানির মৃত্যুকে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনা নস্যাতের একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে। যেকোনো ক্ষেত্রে গুপ্তহত্যা ইরানি সরকারি জীবন ও অনুশীলনের সকল স্তরে ইসরায়েলের ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিকল্পনার প্রমাণ বলে মনে হয়। এটি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ‘মাথা কেটে ফেলা’ নয়।
তৃতীয় একটি প্রস্তাব হলো–ইসরায়েল তেহরানে ‘শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন’ শুরুর জন্য বদ্ধপরিকর থাকা। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে এই কথা বলেছেন। তিনি ‘ইরানের গর্বিত জনগণের’ প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তাদের ‘এক দুষ্ট ও দমনমূলক শাসন থেকে স্বাধীনতার’ জন্য রুখে দাঁড়াতে।
ইরানিরা ইসরায়েলের অবিরাম ও একতরফা বোমা হামলায় ইসরায়েলের নির্দেশ মেনে চলবে–এমন ধারণা অনেকটা এমন যে, ইসরায়েল যদি গাজায় ফিলিস্তিনিদের পর্যাপ্ত পরিমাণে অনাহারে রাখে এবং নির্মূল করে, তাহলে তারা হামাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে এবং তাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবে।
সব ইরানি নিজ দেশের শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য একটি ইসরায়েলি হামলার অপেক্ষায় আছে বলে ধরে নেওয়াটা ইরানি রাজনীতির চালিকাশক্তি সম্পর্কে গভীর বোঝাপড়ার অভাবকেই প্রমাণ করে। যদিও অনেক ইরানি নিঃসন্দেহে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের বিরোধিতা করে। কিন্তু সব রাজনৈতিক মতাদর্শের ইরানিই সবসময় ‘দেশপ্রেমিক’। তারা তাদের দেশের ওপর বাইরের কোনো শক্তির এজেন্ডা চাপিয়ে দেওয়ার যেকোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ইরানি সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতার সমর্থনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
প্রকৃতপক্ষে, নেতানিয়াহুর আপসহীন সমালোচক মনে বলে নিজেদের মনে করা অনেক ইসরায়েলি এ হামলা শুরু হতেই সজাগ হয়েছেন এবং এখন সরকারকে প্রকাশ্যে সমর্থন করছেন। এ তালিকায় পার্লামেন্টের ‘বিরোধী’ সদস্যরাও রয়েছেন। ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের অনেক বিরোধীও ঠিক একইভাবে এখন ইরানের সার্বভৌমত্বের ওপর এ আঘাতের পর একই পতাকাতলে সমবেত হচ্ছেন। ইসরায়েল কেবল হামলা চালিয়ে জনপ্রিয় ইরানি বিদ্রোহের ‘ভিত্তি স্থাপন’ করছে দাবি করাটা–ভীষণভাবে একটি নিন্দনীয় কারসাজি।
ইসরায়েল এসব কারণে ইরানকে আক্রমণ করেনি। তাহলে, কী কারণে এই আক্রমণ চালাল? গাজায় গণহত্যার অভিযানের মধ্যে নেতানিয়াহু খুব ভালো করেই জানেন যে, তাঁর সরকারের বিকল্প ফুরিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, পাশাপাশি আঞ্চলিক মিত্ররাও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শুরু করেছে। কেউ কেউ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে গণস্বীকৃতি দেওয়ার মতো একতরফা পদক্ষেপ নিতেও প্রস্তুতি নিচ্ছে।
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আসন্ন এবং ইসরায়েলের দখলদারত্বের বৈধতা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। ইসরায়েল এবং তার সামরিক বাহিনী ধারাবাহিকভাবে গণহত্যা চালিয়েছে, সেগুলো অস্বীকার করেছে এবং তাদের দাবি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
কোনো সন্দেহ নেই যে, নেতানিয়াহু বছরের পর বছর ইরানের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেছেন। শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। এই সময়টি এল গত শুক্রবার। ইসরায়েল সৃষ্টির পর থেকে যে নিরঙ্কুশ দায়মুক্তি উপভোগ করেছে, তা থেকে বঞ্চিত করার প্রস্তুতি চলার ঠিক সেই মুহূর্তে এ হামলা ইসরায়েলের পেছনে বিশ্বকে একত্রিত করার এক মরিয়া প্রচেষ্টা।
ইরানকে এখনো গ্লোবাল নর্থের অনেক শীর্ষস্থানীয় শক্তি দ্বারা সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একতরফা ইসরায়েলি প্রাণঘাতী পদক্ষেপের সাথে যুক্ত পরিচিত প্রবাদ-প্রবচন‑ঐশ্বরিক প্রতিশ্রুতি থেকে হলোকাস্ট পর্যন্ত। এটা উল্লেখ করেই নেতানিয়াহু স্থিতাবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশা করেছিলেন এটা জানান দিতে যে, ইসরায়েল এখনো যা খুশি তাই করতে পারে।
এটিই ইসরায়েলের ‘নিরাপত্তা’র বর্তমান সংজ্ঞা, যা এর সবচেয়ে পবিত্র নীতি। এটি ইসরায়েলিত্বের আপাতদৃষ্টিতে অরাজনৈতিক উৎস, সম্পূর্ণরূপে ইহুদি আধিপত্যবাদের প্রতি নিবেদিত স্থান, যা ইহুদি জীবনের অখণ্ডতা নিশ্চিত করার একমাত্র ‘বাস্তব’ উপায়। ‘নিরাপত্তা’ মানে ইসরায়েল যাকে খুশি, যতক্ষণ খুশি, যেখানে খুশি এবং যখন খুশি হত্যা করতে পারে, এবং এর কাজের জন্য কোনো মূল্য দিতে হবে না।
এই ‘নিরাপত্তা’ই ইসরায়েলকে গাজা থেকে ইয়েমেন, লেবানন ও সিরিয়া এবং এখন ইরানে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার প্রেরণা যুগিয়েছে। অবশ্যই, এমন একটি ‘নিরাপত্তা ব্যবস্থা’ ক্রমাগত প্রসারিত হতে হবে। এটি কখনোই থামতে পারে না। ইরানকে আক্রমণ করে, নেতানিয়াহু সবকিছু বাজি ধরেছেন। ইসরায়েলের পাশাপাশি নিজের জন্যও হেগে এবং দেশীয় আদালতে সম্পূর্ণ ও নিরঙ্কুশ দায়মুক্তির দাবি করেছেন।
এটা কি নেতানিয়াহুকে মুক্তি দেবে? ইসরায়েলি জনগণ কি দেশে তার চরম ব্যর্থতা এবং গাজায় ভয়াবহ অন্যায়ের জন্য তাকে ক্ষমা করবে? বর্তমান ইসরায়েলি জন-আলোচনায় উল্লাসের যে অনুভূতি দেখা যাচ্ছে, তাতে এমনটা খুব ভালোভাবেই হতে পারে।
প্রত্যেক দোকান–হার্ডওয়্যার থেকে খাবার পর্যন্ত বিস্তৃত দীর্ঘ সারিগুলো প্রমাণ করে যে, ইসরায়েলিরা নিছক বেঁচে থাকার স্তরে প্রবেশ করেছে। একটি নিরীহ নাগরিক সমাজ নেতানিয়াহুর জন্য ভালো হতে পারে, কিন্তু এটি একটি শক্তিশালী ইসরায়েলি সমাজ গঠনে এবং সুরক্ষায় যেকোনো প্রচেষ্টার জন্য অমঙ্গলজনক।
ওরি গোল্ডবার্গ: মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে পিএইচডি করেছেন। তিনি বিশেষ করে ইরানের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।
(লেখাটি আল জাজিরা থেকে নেওয়া এবং ইংরেজি থেকে অনূদিত।)