প্রায় দুই বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর পর, লেবানন ও সিরিয়াকে ধ্বংস করার পর, বারবার ইরান ও ইয়েমেনে হামলা চালানোর পর এবং পশ্চিমা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও গণমাধ্যম অভিজাতদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে মুখ খোলা মাত্রই বিরোধীদের দমন করার পর, ইসরায়েল এখন ইরানকে পঙ্গু বা ধ্বংস করতে তার সবচেয়ে প্রাণঘাতী চেষ্টা শুরু করেছে। ইরানই তার (ইসরায়েলের) অবশিষ্ট থাকা শেষ প্রতিপক্ষ, যার গুরুতর ক্ষতি করার সামর্থ্য রয়েছে।
রাশিয়া যেমনটা বলেছে, ইরানের ওপর ইসরায়েলের ব্যাপক আক্রমণ নিঃসন্দেহে ফৌজদারি অপরাধ। এটি জাতিসংঘ সনদ এবং সাধারণভাবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। বিশেষ করে এটি একটি ‘ন্যায়সঙ্গত আত্মরক্ষামূলক প্রতিরোধমূলক হামলা’র জন্য যে সংকীর্ণ ও আইনি মানদণ্ড রয়েছে, তা পূরণ করে না। নিজেদের কর্মকাণ্ডকে আড়াল করতে ইসরায়েলের এই শব্দগুচ্ছ ব্যবহারের নির্লজ্জ চেষ্টা নিছকই এক তথ্যযুদ্ধ। এগুলো অপমানজনক ও বেপরোয়া। আর এটা এমন এক প্রচার, যা কেবল স্বেচ্ছা নির্বোধদেরই ‘প্রভাবিত’ করতে পারে। অনাহার দ্বারা সৃষ্ট গণহত্যাসহ যাবতীয় গণহত্যাকে ‘আত্মরক্ষা’ বলে চালানোর ইসরায়েলি অভ্যাসের মতোই এটা হাস্যকর ও জঘন্য।
প্রসঙ্গত, এই প্রেক্ষাপটে বিস্মিত হওয়ার মতো কিছু নেই যে, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের কৌশলগুলোর মধ্যে একই ধরনের বিশ্বাসঘাতকতামূলক পদ্ধতিই অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইসরায়েল তার প্রতিপক্ষের ভূখণ্ডের ভেতর থেকেই চোরাগোপ্তা ড্রোন হামলা চালিয়েছে। সশস্ত্র সংঘাতের আইন অনুযায়ী, আক্ষরিক ও কৌশলগত–দুই অর্থেই ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ অপরাধ। সম্প্রতি এই একই কাজ পশ্চিমা মিত্রদের সহায়তায় করেছিল ইউক্রেনের জেলেনস্কি সরকার।
বাস্তবে যদি কোনো রাষ্ট্রের এই ক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক হামলার অধিকার দাবি করার মতো কোনো উপযুক্ত যুক্তি থাকত, তাহলে সেটি ইরানেরই থাকত। কারণ, সামরিক হামলাকে প্রতিরোধমূলক হিসেবে বিবেচনা করার মূল মানদণ্ড হলো–এটি একটি আসন্ন শত্রু আক্রমণকে ব্যাহত করবে। ইসরায়েল এবং তার সহায়ক আমেরিকা সম্প্রতি ইরানকে এমন হামলার হুমকি না দিয়ে একটি দিনও পার করেনি, যা এখন বাস্তবে ঘটেছে। তাই এমন হামলা ইরান চালালে, তেহরানের কাছে বরং চমৎকার প্রমাণ থাকত যে, ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের আসন্ন আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক হামলা চালিয়েছে তারা।
তবুও বিশেষত, দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে একটি সরাসরি সম্প্রচারিত জায়নবাদী ঔপনিবেশিক গণহত্যা, যা মূলত ইসরায়েল ও পশ্চিমারা যৌথভাবে চালিয়েছে, তা দেখার পর আমরা জানি যে, পশ্চিমা দেশগুলোর ‘মূল্যবোধ-সম্পর্কিত’ নারকীয় ‘নিয়ম-ভিত্তিক’ বিশ্বে আন্তর্জাতিক আইনের গুরুত্ব খুবই কম।
অতএব, মূল প্রশ্ন এটা নয় যে, ইসরায়েলের এমন কাজ করার অধিকার থাকতে পারে কিনা? এর একটা সহজ উত্তর: একদমই না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এ উত্তর ইসরায়েলের শিকারদের কোনো সাহায্য করে না। ইসরায়েল হলো দায়মুক্তির মূর্ত প্রতীক। আধুনিক ইতিহাসে যেসব দানবীয় রাষ্ট্র ভয়ংকর অপরাধ সংঘটিত করেছে, তাদের মধ্যে ইসরায়েলের মতো কোনো রাষ্ট্রই খুন (আসলে গণহত্যা) করে পার পায়নি। অবশ্যই তালিকায় আমেরিকারও আছে।
ইসরায়েলি ভিন্নমতাবলম্বী এবং গণহত্যা বিশেষজ্ঞ রাজ সেগাল সম্প্রতি বলছেন, আইনের ঊর্ধ্বে থাকার অনুভূতিটিই এত এত ইসরায়েলির নির্মম গণহত্যাকারী হিসেবে কাজ করা এবং এ কাজ উপভোগ করার পেছনের মূল কারণ। এ কারণেই আসল প্রশ্ন, যা বাস্তব পৃথিবীর জন্য প্রাসঙ্গিক, তা হলো–কেন ইসরায়েল যা করছে, তা করতে পারে? আর এর সংক্ষিপ্ত, এক শব্দের উত্তর হলো: আমেরিকা। পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্র (পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দানবীয় সংগঠন) এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও ইসরায়েলের নৃশংসতার সাথে জড়িত। তবে ক্ষমতার বিচারে ওয়াশিংটনই সিদ্ধান্তগ্রহীতার জায়গায় রয়েছে। আমেরিকার সমর্থনের কারণেই ইসরায়েল তার সীমাহীন অপরাধগুলো কোনো পরিণতির তোয়াক্কা না করেই চালিয়ে যেতে পারে।
শুধু কল্পনা করুন যে, আমেরিকার সমর্থন ছাড়া ইসরায়েলের মতো ভৌগোলিকভাবে ও জনসংখ্যার দিক থেকে এত ক্ষুদ্র এবং ভূ-রাজনৈতিকভাবে এত ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্র এমন আগ্রাসন চালাচ্ছে। ঠিক ধরেছেন–এমনটা কল্পনাই করা যায় না। কারণ কারও সমর্থন না থাকলে এমন রাষ্ট্র অনেক আগেই বিলীন হয়ে যেত।
তবুও ইসরায়েলের সর্বশেষ এই নিন্দনীয় হামলার বিষয়ে ওয়াশিংটন দাবি করছে যে, তারা এতে অংশ নেয়নি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও আমাদের বিশ্বাস করাতে চান যে, ইসরায়েলের এই আক্রমণ ছিল ‘একতরফা’ এবং আমেরিকা এতে ‘জড়িত ছিল না’। এমন সরলমনা কেউ কি এখনো অবশিষ্ট আছে যে, দুটি সহজ সত্য বোঝে না? যেমন: ওয়াশিংটন সহজে এবং দ্বিধা ছাড়াই মিথ্যা বলে, এবং মার্কিন-ইসরায়েল সহাবস্থান এতটাই দৃঢ় ও ব্যাপক যে, আমেরিকান যোগসাজশ ও নির্দেশনা ছাড়া ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আক্রমণ, বিশেষ করে এই মাত্রার, তা অকল্পনীয়।
চলুন এই ডাহা মিথ্যার কথা ছাড়ি। এ হলো সেই পুরোনো মার্কিন সত্তা। আরও মজার ব্যাপার হলো, এমনকি তাদের নিজস্ব ভুয়া শর্ত সত্ত্বেও ওয়াশিংটনের সরকারি অবস্থানটি অসার। ওয়াশিংটন অযৌক্তিকভাবে দাবি করেছে যে, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের চালানো অপরাধমূলক হামলায় তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। ব্লুমবার্গ ও ওয়াশিংটন পোস্টের মতো মার্কিন মূলধারার সংবাদমাধ্যম ভানে মত্ত। তাদের ভাষ্য হলো–প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো ইরানের সাথে আলোচনা ইসরায়েলের ‘অতি-স্বাধীন’ হামলার দ্বারা বিঘ্নিত হতে পারে। তারা এখনো অবিবেচকের মতো ট্রাম্পকে উদ্ধৃত করে বলছেন যে, ইসরায়েলি হামলার ঠিক আগের দিনও তিনি ইসরায়েলি হামলার বিরোধিতা করেছিলেন। ব্লুমবার্গের মতে, এর অর্থ হলো ইসরায়েল ট্রাম্পের ‘স্পষ্ট বিরোধিতা’ করে হামলা চালিয়েছে।
সত্যিই? সেই পুরোনো ‘নেতা জানতেন না’ ধরনের সাফাই? এটা মজার; কারণ, ইতিমধ্যেই ট্রাম্প নিজেই স্বীকার করেছেন যে, তিনি হামলা সম্পর্কে জানতেন, বিকৃতভাবে ইরানকে দোষারোপ করেছেন, ইসরায়েলকে নয় এবং তেহরানকে মূলত আত্মসমর্পণ করতে আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে ইসরায়েল এত কঠিন আঘাত হানার আগে ইরানের কিছুই অবশিষ্ট না থাকে। আর এই সবকিছু এমন সময় ঘটছে, যখন ইসরায়েল ইতিমধ্যেই আরও দুই সপ্তাহের ‘অপারেশন’ অথবা আরও বেশি সময় ধরে, অর্থাৎ ‘যতদিন লাগে’ ততদিন হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে। ফলে ট্রাম্প কেবল আগ্রাসী ইসরায়েলের পক্ষেই স্পষ্ট অবস্থান নেননি, বরং এও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তিনি তাঁর ইসরায়েলি বন্ধুদের ইরানকে যতক্ষণ খুশি আঘাত করতে দিতে রাজি আছেন, এমনকি ইরানকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা পর্যন্তও।
অর্থাৎ, ওয়াশিংটনের অবিশ্বাস্য সরকারি গল্পটি হলো–প্রথমত, ইসরায়েল আমেরিকার ঘোষিত নীতিকে ব্যাপকভাবে অমান্য করেছে; দ্বিতীয়ত, আমেরিকা আসলে কিছু মনে করে না; এবং তৃতীয়ত, ওয়াশিংটন বিশ্বের সামনে বোকা বনতে ভালোবাসে, যদি তা ইসরায়েল করে।
আসলে তারা এতটাই ভালোবাসে যে, আমেরিকান প্রতিক্রিয়া হলো–অবিলম্বে ইসরায়েলের পক্ষ অবস্থান নেওয়া, তার ‘উদ্ধত’ বন্ধুদের যা খুশি তাই করার জন্য একটি ব্লাঙ্ক চেক লিখে দেওয়া। কারণ যারা ট্রাম্পকে ‘স্পষ্টতই অমান্য’ করেছে, তাদের তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে, তারা শুধু নিজেদের ইচ্ছামতো ইরানকে আঘাত করতেই পারবে না, উপরন্তু যদি ইরান পাল্টা আঘাত হানার চেষ্টা করে, তবে আমেরিকাও সবসময় তাদের ইরান থেকে রক্ষা করবে।
এমনকি ওয়াশিংটনের মিথ্যাগুলোও ভীষণভাবে প্রকাশ্য। ইরানে ইসরায়েলের হামলায় জড়িত না থাকার মিথ্যাটা সুস্পষ্ট বার্তা দেয় যে, মার্কিন অভিজাত শ্রেণি এখন প্রকাশ্যে সবকিছুতে ইসরায়েল এবং এর মার্কিন লবির কাছে ভীষণভাবে নত। অথচ এর সঙ্গে সাধারণ আমেরিকানদের স্বার্থও অন্তর্ভুক্ত। সত্য হলো–আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আগ্রাসী যুদ্ধে গভীরভাবে জড়িত। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ার পর অজেয় এই শক্তি আপাতত তাদের শেষ শিকারের কাছে পৌঁছাচ্ছে।
এখানে মিথ্যাটা হলো–আমেরিকা ভান করছে যে, তারা জড়িত নয়। আর পুরো ঘটনাটির চূড়ান্ত, অনিচ্ছাকৃত প্রকাশ হলো এই যে, ওয়াশিংটনের অভিজাতরা এমন একটি মিথ্যাকে যথেষ্ট ভালো গল্প বলে মনে করে। এ থেকে বোঝা যায় যে, তারা ইসরায়েলের কতটা বাধ্য। এমনকি ইসরায়েল যখন সরাসরি তাদের ‘অমান্য’ও করে তখনো। কারণ ইসরায়েলের কাছে সম্পূর্ণ ও কাপুরুষোচিত আত্মসমর্পণ এখন আমেরিকার জন্য পুরোপুরি স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়। এবং এটিই আসলে বর্তমান আমেরিকার মৌলিক সত্য।
তারিক সিরিল: একজন ইতিহাসবিদ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশেষজ্ঞ। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক ইতিহাসে স্নাতক, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে আন্তর্জাতিক ইতিহাসে স্নাতকোত্তর এবং প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
(লেখাটি আরটি ডট কম-এ প্রকাশিত এবং ইংরেজি থেকে অনুদিত।)