দুঃখজনক হলেও সত্য, ২০২৫ সালে এসে আশা করা গিয়েছিল যে, বৈশ্বিক সম্প্রদায় জলবায়ু পরিবর্তনের মতো অস্তিত্বের সংকট মোকাবিলায়, ভবিষ্যতের মহামারি প্রতিরোধে, বিদ্যমান ব্যাপক আয় ও সম্পদের বৈষম্য নিরসনে এবং সারা বিশ্বের অভাবি মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আজ আমরা সেই জায়গায় নেই। বরং এর বিপরীত চিত্রই দেখা যাচ্ছে। আমরা যে বড় সংকটগুলোর মুখোমুখি, সেগুলোর সমাধান না করে বিশ্ব এখন পুতিন কর্তৃক ইউক্রেনে শুরু হওয়া এক ভয়ংকর যুদ্ধের দিকে তাকিয়ে আছে, যা গত ৩ বছরে লাখ লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে।
আমরা গাজায় ভয়াবহ যুদ্ধ দেখছি। যেখানে এই মুহূর্তে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শিশু ইসরায়েলের অমানবিক ও অবৈধ যুদ্ধনীতির কারণে অনাহারের মুখোমুখি। আর এখন আমরা ইরানে একটি বিপজ্জনক ও ক্রমবর্ধমান যুদ্ধের সম্মুখীন। চরমপন্থী নেতানিয়াহু সরকার আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে এই যুদ্ধ শুরু করেছে। আজ আমি যে মূল বিষয়টি বলতে চাই, তা হলো, আমেরিকার এই যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়াটা একেবারেই অপরিহার্য। এই যুদ্ধ কীভাবে শুরু হয়েছিল সে সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই।
গত বৃহস্পতিবার (আমেরিকার সময়) নেতানিয়াহু ইরানের ওপর একটি অবৈধ ও একতরফা আকস্মিক হামলা চালিয়েছেন। তিনি ইরান জুড়ে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে বোমা ফেলে শত শত মানুষকে হত্যা করেছেন। ইরানও পাল্টা হামলা চালিয়েছে, যাতে ইসরায়েলে কয়েক ডজন মানুষ নিহত হয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত ও স্বৈরাচারী ইরানি শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আপনার যাই মনে হোক না কেন, ইসরায়েলের এই হামলা আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের সনদকে স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করেছে।
যদিও প্রতিটি দেশের আত্মরক্ষার অধিকার আছে, তবে তাদের এই ধরনের তথাকথিত আত্মরক্ষার নামে যুদ্ধ শুরু করার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু চলুন দেখা যাক, নেতানিয়াহুকে। তিনি গাজায় নিরীহ মানুষকে অনাহারে রাখা এবং বেসামরিক নাগরিক হত্যার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক অভিযুক্ত একজন যুদ্ধাপরাধী। এই মুহূর্তে গাজায় ইসরায়েল জাতিসংঘকে মানবিক সহায়তা বিতরণে বাধা দিয়ে চলেছে। এবং আজকের দিনেও গাজায় ইসরায়েলি ট্যাঙ্কগুলো ভিড়ের মধ্যে গোলা বর্ষণ করেছে, যেখানে মানুষ মরিয়া হয়ে খাবার সংগ্রহ করার চেষ্টা করছিল। এতে কমপক্ষে ৫৯ জন নিহত হয়েছেন।
এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে নেতানিয়াহু ইরানের সঙ্গে এই যুদ্ধ শুরু করতে আন্তর্জাতিক আইনকে উপেক্ষা করেছেন। তবে নেতানিয়াহুর হামলার সিদ্ধান্ত আমেরিকার সুস্পষ্ট ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছিল, যারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে দীর্ঘদিনের উত্তেজনা নিরসনে একটি কূটনৈতিক সমাধান খুঁজছিল। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আমেরিকা এই দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ নিরসনে ইরানের সঙ্গে পাঁচ দফা আলোচনা করেছে।
আমি আবারও বলছি। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে, আমেরিকা ইরানের সাথে দীর্ঘদিনের উদ্বেগ নিরসনে পাঁচ দফা আলোচনা করেছে। রোববার ষষ্ঠ দফা আলোচনার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু নেতানিয়াহু তার পরিবর্তে দু দিন আগেই এই যুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। সুতরাং এটা পরিষ্কার হওয়া দরকার যে, ইসরায়েলের এই হামলা বিশেষভাবে আমেরিকান কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, তাদের প্রথম দফার হামলায় ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক আলোচনা দলের তত্ত্বাবধায়ককে হত্যা করে। এটিও মনে রাখা দরকার যে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা কখনোই ইঙ্গিত দেয়নি যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মাত্র কয়েক মাস আগে, ট্রাম্পের নিজস্ব জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড কংগ্রেসে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে, ‘গোয়েন্দারা ক্রমাগত এই মূল্যায়ন করে চলেছেন যে, ইরান কোনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না।’ কিন্তু নেতানিয়াহু আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে পঙ্গু করে দিয়েছে এবং একটি পূর্ণাঙ্গ আঞ্চলিক যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি করেছে। তিনি এখন প্রকাশ্যে ইরানে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা বলছেন এবং কোনো বিশৃঙ্খলার পরিণতি চিন্তা না করেই সে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে হত্যার হুমকি দিচ্ছেন।
ভিডিও দেখুন:
আমরা এ কথাও যেন ভুলে না যাই যে, ইরানের বর্তমান ইসলামিক শাসনব্যবস্থা নিজেই ১৯৫৩ সালের একটি পশ্চিমা-সমর্থিত অভ্যুত্থানের ফসল, যা ইরানের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরশাসকের দ্বারা প্রতিস্থাপিত করেছিল। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, আমেরিকা কি নেতানিয়াহুর এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে? আমার মতে, এটা হবে একটা বিপর্যয়। নেতানিয়াহুর আর কোনো যুদ্ধে সামরিক বা অর্থনৈতিক কোনোভাবেই জড়িত হওয়া উচিত নয় আমেরিকার।আমেরিকার সংবিধান অত্যন্ত স্পষ্ট। কংগ্রেসের সুস্পষ্ট অনুমোদন ছাড়া ইরান বা অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীকে হামলার জন্য ব্যবহার করা যাবে না। এমন কোনো অনুমোদন নেই এবং তাই আমেরিকার এই যুদ্ধে যেকোনো প্রকারে জড়িত হওয়াটা হবে অবৈধ। আমেরিকা গত কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলকে ইতিমধ্যেই শত শত বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। শুধুমাত্র গত বছরেই, মার্কিন করদাতারা ইসরায়েলকে ২২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সামরিক সহায়তা দিয়েছে। এদিকে, ইসরায়েলকে বিপুল পরিমাণে সহায়তা প্রদানের ফলে আমাদের আমেরিকানরা রাস্তায় ঘুমাচ্ছে, যারা স্বাস্থ্যসেবা বা অন্যান্য মৌলিক চাহিদা মেটাতে অক্ষম।
যথেষ্ট হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেকে একজন শান্তিকামী হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। তার উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার সবচেয়ে গর্বের উত্তরাধিকার হবে একজন শান্তিস্থাপক এবং ঐক্যবদ্ধকারীর। আমি এটাই হতে চাই, একজন শান্তিস্থাপক এবং একজন ঐক্যবদ্ধকারী।’ খুব সুন্দর কথা। ট্রাম্পের আজ এই কথাগুলো মনে রাখা উচিত।
ইরানের বিরুদ্ধে নেতানিয়াহুর যুদ্ধকে সমর্থন করা হবে একটি ভয়াবহ ভুল। যুদ্ধে না গিয়ে, ট্রাম্পের উচিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে কাজ করে নেতানিয়াহুকে সংযত করা এবং জরুরিভাবে একটি কূটনৈতিক সমাধানের জন্য চাপ সৃষ্টি করা। নেতানিয়াহুর এই অবৈধ হামলা বিশ্বকে আরও বিপজ্জনক স্থানে পরিণত করেছে। আমেরিকার এই যুদ্ধের অংশ হওয়া উচিত নয়।
বার্নি স্যান্ডার্স: ডেমোক্র্যাট দলীয় একজন আমেরিকান রাজনীতিবিদ এবং ভারমন্ট অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত সিনিয়র মার্কিন সিনেটর
(লেখাটি বার্নি স্যান্ডার্সের ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলে গত ১৭ জুন প্রকাশিত বক্তব্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।)