বাংলাদেশের বাজেটের প্রায় অর্ধেক পরিমাণ অর্থ খরচ করে একটি প্রতিষ্ঠান কিনতে যাচ্ছে সার্চ ইঞ্জিন জায়ান্ট গুগল। সাইবার নিরাপত্তা (সাইবার সিকিউরিটি) প্রতিষ্ঠান ‘উইজ’-কে অধিগ্রহণের জন্য রেকর্ড ৩২ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি সম্পাদন করেছে গুগল। চুক্তির বিষয়টি ঘোষণা আকারে এসেছে গত মঙ্গলবার (১৮ মার্চ)। ‘উইজ’ ক্রয়ের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হলে গুগলের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল অধিগ্রহণ হতে যাচ্ছে এটি।
উল্লেখ্য, উইজ কেনার জন্য গুগলের প্রস্তাবিত ৩২ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশী মুদ্রায় দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি, যেটি বাংলাদেশের বর্তমান বাজেটের (৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার) প্রায় অর্ধেক। চুক্তি অনুযায়ী ৩২ বিলিয়ন ডলারের পুরোটাই উইজকে নগদ (ক্যাশে) প্রদান করবে গুগল।
গুগল ও উইজের মধ্যে সম্পাদিত ৩২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনুমোদন দিলে ‘উইজ’ গুগল ক্লাউডের অংশ হয়ে যাবে। গুগলের মূল সংস্থা অ্যালফাবেটের ৩৫০ বিলিয়ন ডলার বার্ষিক আয়ের সিংহভাগই আসে সার্চ ইঞ্জিন ও বিজ্ঞাপন থেকে, কিন্তু ক্লাউড ব্যবসাও তাঁদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে এআই প্রযুক্তির কল্যাণে প্রযুক্তি বিশ্বে ক্লাউড সার্ভিসের চাহিদাও উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষাপটে গুগল দীর্ঘদিন ধরেই ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাঁদের ক্লাউড বিজনেসের পরিধি বাড়াতে জোরদার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। সে অনুযায়ী ফলও পেয়েছে তাঁরা। এআই প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়ছে গুগলের ক্লাউড বিজনেসের আয়ও ততই যেন ফুলে-ফেঁপে উঠছে। তাঁদের ক্লাউড ডিভিশনের বার্ষিক আয় ২০২২ সালে ২৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৪ সালে ৪৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
ক্লাউড কম্পিউটিং-কে ঘিরে গুগলের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এবার ক্লাউড-ভিত্তিক সাইবার সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠান ‘উইজ’ কিনতে যাচ্ছে গুগল। প্রশ্ন হচ্ছে ‘উইজ’ কেন?
গুগল যে কারণে ‘উইজ’ কিনছে
ডেটা সেন্টারে সংরক্ষিত তথ্যের সুরক্ষা প্রদানে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জাম বা সিকিউরিটি টুল তৈরি করে থাকে ‘উইজ’। ২০২০ সালে চার ইসরায়েলী বন্ধু মিলে প্রতিষ্ঠার পর বিগত ৫ বছরে তাঁদের ক্লাউড-ভিত্তিক সাইবার সিকিউরিটি সার্ভিসের ব্যপ্তি ও জনপ্রিয়তা উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে সমানতালে। এ বছর তাঁদের বার্ষিক আয় ১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রাথমিকভাবে তাঁদের কার্যক্রম ইসরায়েলে শুরু হলেও বর্তমানে উইজের হেডকোয়ার্টার (মূল কার্যালয়) নিউইয়র্কে অবস্থিত। সেখান থেকেই এখন তাঁরা ক্লাউড-ভিত্তিক সাইবার সিকিউরিটি সার্ভিস প্রদান করে থাকে।
উইজ-এর প্রধান নির্বাহী (সিইও) আসাফ রাপাপোর্ট সম্প্রতি একটি ব্লগ পোস্টে লিখেছেন, ‘উইজ ও গুগল ক্লাউড দুটি প্রতিষ্ঠানই বিশ্বাস করে যে, ক্লাউড নিরাপত্তা আরও সহজ, সহজলভ্য, উদ্ভাবনী ও গণতান্ত্রিক হওয়া উচিত, যাতে করে আরও বেশি সংখ্যক প্রতিষ্ঠান নিরাপদে ক্লাউড (সেবা) ও এআই প্রযুক্তি গ্রহণ ও ব্যবহার করতে পারে।’
মঙ্গলবার একটি কনফারেন্স কলে যুক্ত হয়ে গুগলের প্রধান নির্বাহী সুন্দর পিচাই ভবিষ্যৎবাণী করেছেন যে, তাঁদের ক্লাউড ডিভিশনে ‘উইজ’ যুক্ত হলে বর্তমানের চেয়ে কম খরচে আরও ভালো নিরাপত্তা পাওয়া যাবে। এমন ভবিষ্যৎবাণী অবশ্য তিন কেবলমাত্র গ্রাহকদের উদ্দেশ্য করে করেননি। বরং যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা উইজের সাথে চুক্তিটি পর্যালোচনা করে অনুমোদন দেবেন তাঁদেরকে এর গুরুত্ব বোঝাতেও এমন কথা বলেছেন পিচাই। উল্লেখ্য, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ হচ্ছে এই চুক্তির ফলে বাজারে প্রতিযোগিতা ও দামের ওপর কী প্রভাব পড়বে তা খতিয়ে দেখা।
গুগল অনেকদিন ধরেই ‘ইউজ’-কে অধিগ্রহণের চেষ্টা করে আসছিল। গত জুলাইতে (২০২৪) উইজকে গুগল ২৩ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব দিয়েছিল বলে জানা যায়, যেটা উইজ প্রত্যাখ্যান করে। সে সময় প্রতিষ্ঠানটি শেয়ার বাজার যোগ দিয়ে বিনিয়োগ উত্তোলনেরও ইঙ্গিত দিয়েছিল। তবে এবারে গুগলের ৩২ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাবে তাঁরা রাজি হয়েছে এবং সে অনুযায়ী চুক্তিও সম্পাদন করেছে। চুক্তিটি বর্তমানে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
রেকর্ড ৩২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি!
গুগল ২০১২ সালে মটোরোলা মোবিলিটি অধিগ্রহণ করে ১২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে। কোনো প্রতিষ্ঠানকে কিনে নিতে এখন পর্যন্ত এটাই গুগলের সর্বোচ্চ ব্যয়। কিন্তু এবারে উইজের সাথে ৩২ বিলিয়নের চুক্তিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিলমোহর পড়লে গুগলের সর্বোচ্চ অধিগ্রহণের নতুন রেকর্ডে পরিণত হবে এটি। তবে রেকর্ড শুধু গুগলের জন্যেই নয়, সাইবার নিরাপত্তা খাতেও সবচেয়ে বড় অধিগ্রহণ হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে যাচ্ছে গুগল-উইজের চুক্তিটি। এমনকি সফটওয়্যার খাতের ইতিহাসেও সবচেয়ে ব্যয়বহুল ২০টি অধিগ্রহণের একটি হতে এটি।
ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের বাজারে মাইক্রোসফট ও অ্যামাজন ইতোমধ্যেই বড় অংকের বিনিয়োগ করেছে। এবারে বিপুল অর্থ ব্যয়ে উইজ কিনে নেওয়ার মাধ্যমে গুগল তাঁদেরকে বেশ স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে বলেই মনে করছে বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা ওয়েডবুশ। ক্লাউড বিজনেসে মাইক্রোসফট ও অ্যামাজনের তুলনায় মাঝে কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও ‘উইজ’ অধিগ্রহণের মাধ্যমে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে স্বরুপে ফিরে আসছে গুগল।
তথ্যসূত্র: এপি, ইকোনমিক টাইমস, বিজনেস ইনসাইডার