মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামে মোবাইল সার্ভিস চালু হতে যাচ্ছে আমেরিকায়। সার্ভিসটির নাম রাখা হয়েছে ‘ট্রাম্প মোবাইল’। ট্রাম্পের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান- দ্য ট্রাম্প অর্গানাইজেশন- গতকাল সোমবার (১৬ জুন) এ সার্ভিসটি নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছে। ‘ট্রাম্প মোবাইল’ ব্র্যান্ডের অধীনে ৪৯৯ ডলার মূল্যের একটি স্মার্টফোন নিয়ে আসার কথাও জানিয়েছে ট্রাম্পের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটি।
উল্লেখ্য, ‘টি১ ফোন ৮০০২’ মডেলের স্মার্টফোনটি আগামী সেপ্টেম্বর থেকে গ্রাহকের হাতে পৌঁছাতে শুরু করবে বলে ‘ট্রাম্প মোবাইল’-এর অফিশিয়াল ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে। ট্রাম্প ব্র্যান্ডের এই ফোনটি আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ হাতে পেতে চাইলে গ্রাহকরা ১০০ ডলার দিয়ে এটি প্রি-বুকিং করতে পারেন।
ট্রাম্প মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবা
‘ট্রাম্প মোবাইল’ বলছে, আমেরিকার শীর্ষ তিনটি মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (ভেরিজোন, টি-মোবাইল ও এটিএন্ডটি) যে নেটওয়ার্ক কভারেজ অফার করে থাকে তাঁরাও গ্রাহকদেরকে একই নেটওয়ার্ক কভারেজে ৫জি মানের ডেটা অফার করতে সক্ষম।
পাশাপাশি আমেরিকা-ভিত্তিক একটি কাস্টমার সার্ভিস কল সেন্টারকেও সহায়তা প্রদান করবে ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবা। তবে নিরাপত্তা সম্পর্কিত কারণ দেখিয়ে কল সেন্টারটি আমেরিকার কোথায় অবস্থিত এ সম্পর্কে কিছু জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন ট্রাম্প মোবাইলের একজন প্রতিনিধি।
‘ট্রাম্প মোবাইল’ নেটওয়ার্ক সেবার অধীনে গ্রাহকরা যত ইচ্ছা তত কথা বলতে পারবেন, টেক্সট মেসেজ পাঠাতে পারবেন এবং মোবাইল ডেটা (ইন্টারনেট) ব্যবহার করতে পারবেন। এর জন্য গ্রাহকদেরকে প্রতি মাসে গুণতে হবে ৪৭ ডলার ৪৫ সেন্ট (৪৭.৪৫ ডলার)। বাংলাদেশি মুদ্রায় অর্থের অঙ্কটা ৫ হাজার ৮০০ টাকা।
এই অফারটিকে ‘দ্য ৪৭ প্ল্যান’ নামে অভিহিত করেছে ট্রাম্প মোবাইল। অর্থাৎ, এই অর্থের বিনিময়ে প্রতি মাসে আনলিমিটেড টকটাইম, টেক্সট মেসেজ ও ডেটা উপভোগ করতে পারবেন গ্রাহকরা। তবে এর বাইরেও আরও কিছু সুবিধা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ট্রাম্প মোবাইল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:
১। ডিভাইসের পূর্ণাঙ্গ সুরক্ষা
২। ‘ড্রাইভ আমেরিকা’ উদ্যোগের মাধ্যমে সপ্তাহের প্রতিদিন ২৪ ঘন্টা রাস্তার পাশে সহায়তা পাবেন গ্রাহকরা।
৩। টেলিহেলথ্ সেবা নিতে পারবেন ট্রাম্প মোবাইল গ্রাহকরা। এর মধ্যে আছে ভার্চুয়াল মেডিক্যাল সেবা, মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সহায়তা, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনে উল্লেখিত ওষুধ সহজে অর্ডার করার এবং হাতে পাওয়ার সুযোগ।
৪। বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে বিনামূল্যে কল করার সুবিধা। বিশেষ করে আমেরিকার সেনাবাহিনীর ঘাঁটি আছে এমন দেশগুলোতে বিনামূল্যে কথা বলার সুযোগ করে দিবে ট্রাম্প মোবাইল। সেনাবাহিনীর সদস্যদের সম্মানার্থেই এই সুবিধা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটি তাঁদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে।
তবে আমেরিকার জনপ্রিয় নেটওয়ার্ক সেবাদাতাদের একই ধরণের প্ল্যানের তুলনায় ট্রাম্প মোবাইলের ‘দ্য ৪৭ প্ল্যান’ কিছুটা ব্যয়বহুল বলেই মনে হচ্ছে। উদাহরণস্বরুপ, ভেরিজোনের বাজেট প্ল্যান ‘ভিজিবল’ যারা নিয়েছেন তাদেরকে আনলিমিটেড কথা বলা, টেক্সট পাঠানো, ডেটা আক্সেস ও হটস্পট ব্যবহারের জন্য প্রতি মাসে খরচ করতে হয় ২৫ ডলার। সেখানে ট্রাম্প মোবাইলে একই সুবিধা পেতে গুণতে হবে ৪৭.৪৫ ডলার।
ট্রাম্পের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবা ও স্মার্টফোন নিয়ে আসার বিষয়ে এখনও কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি দেশটির শীর্ষ তিন মোবাইল ফোন অপারেটর প্রতিষ্ঠান- ভেরিজোন, টি-মোবাইল ও এটিএন্ডটি।
ট্রাম্প মোবাইলের ‘টি১ ফোন ৮০০২’ স্মার্টফোনটিতে যা পাচ্ছেন গ্রাহকরা
ট্রাম্পের প্রতিষ্ঠান আরও জানিয়েছে যে, ‘টি১ ফোন ৮০০২’ স্মার্টফোনটি বাজারে আসবে সোনালি রঙের মেটাল কেসিংয়ে, যেখানে খোঁদাই করা থাকবে আমেরিকান পতাকা। এতে বেশ কিছু আকর্ষণীয় ফিচার অফার করছে ট্রাম্প মোবাইল। এর ৬.৮-ইঞ্চির পাঞ্চ হোল অ্যামোলেড ডিসপ্লেতে ১২০হার্জ রিফ্রেশ রেটের সাপোর্ট পাবেন ব্যবহারকারীরা।
টি১ ফোনটিতে আরও আছে ১২জিবি র্যাম, ২৫৬জিবি স্টোরেজ এবং ৫ হাজার মিলিঅ্যাম্পিয়ার আওয়ার সক্ষমতার ব্যাটারি। ৫০ মেগাপিক্সেলের মূল ক্যামেরা সহ ফোনটির ব্যাকসাইডে আছে ৩টি ক্যামেরা এবং সেলফি ক্যামেরা যথারীতি থাকছে ডিসপ্লের একেবারে ওপরের দিকে মাঝখানে। এছাড়া ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর ও ফেস আনলক সুবিধাও রয়েছে ব্যবহারকারীদের জন্য। এখানেই শেষ নয়, অ্যান্ড্রয়েড ১৫ অপারেটিং সিস্টেমের এই ফোনটিতে থাকছে ৩.৫ মিলিমিটারের হেডফোন জ্যাকও।
তবে ফোনটির সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি ট্রাম্প মোবাইলের ওয়েবসাইটে। এই যেমন, ফোনটির ফিচারে প্রসেসর সম্পর্কিত কোনো তথ্যই উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি ফোনটির যে ছবি দেওয়া হয়েছে সেটা আসল কি-না তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকে।
ট্রাম্পের নামে মোবাইল ফোন আসায় তৈরি হতে পারে স্বার্থের দ্বন্দ্ব
তবে ট্রাম্পের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের নতুন এই উদ্যোগ ইতোমধ্যেই সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্টের নামে তাঁর নিজের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে নতুন স্মার্টফোন ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবার প্রচলন দেশটির ইতিহাসে এর আগে কখনও দেখা যায়নি বলেই জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অনেকেই আবার এক্ষেত্রে স্বার্থের দ্বন্দ্ব (কনফ্লিক্ট অব ইনটারেস্ট) তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও দেখছেন।
উল্লেখ্য, ট্রাম্প মোবাইলের ওয়্যারলেস সার্ভিসের নাম (দ্য ৪৭ প্ল্যান) ও দাম (৪৭ ডলার ৪৫ সেন্ট)- এই দুটোতেই রয়েছে ট্রাম্পের রেফারেন্স। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের প্রথম মেয়াদে (২০১৬-২০২০) ট্রাম্প ছিলেন আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট। এ বছর দ্বিতীয় মেয়াদে শপথ নিয়ে তিনি হয়েছেন ৪৭তম প্রেসিডেন্ট। অর্থাৎ, দেশটির ৪৫তম ও ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর এ কারণেই ট্রাম্প মোবাইলের সার্ভিস ‘দ্য ৪৭ প্ল্যান’-এর মাসিক ফি ধার্য কড়া হয়েছে ৪৭.৪৫ মার্কিন ডলার
শুধু তাই নয়, ট্রাম্প মোবাইলের ওয়েবসাইটে আসন্ন টি১ ফোনের স্ক্রিনশটে শোভা পাচ্ছে ট্রাম্পের রাজনৈতিক স্লোগান ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’।
তবে দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার আগে তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘দ্য ট্রাম্প অর্গানাইজেশন’ জানিয়েছিল যে, এবার প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে ট্রাম্পের সন্তানদের হাতে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদেও।
ট্রাম্প মোবাইলের ওয়েবসাইটে এও বলা আছে যে, ট্রাম্প মোবাইলের কোনো পণ্য বা সেবা ‘দ্য ট্রাম্প অর্গানাইজেশন’ বা তাঁদের কোনো সহযোগী প্রতিষ্ঠান দ্বারা ডিজাইন, বিকাশ, উৎপাদন, বিতরণ বা বিক্রি করা হয় না।
কিন্তু তা স্বত্বেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ঘিরে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরির আশঙ্কা থেকেই গেছে। এবারে ট্রাম্পের নামে মোবাইল সেবা ও স্মার্টফোন আনার ঘোষণায় এ আশঙ্কা আরও ঘনীভূত হয়েছে বলেই মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ টেলিযোগাযোগ খাতের বিভিন্ন অংশীজনদের।
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় তাঁর প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লাইসেন্সিং চুক্তি অর্জন ও অন্যান্য ব্র্যান্ডের মার্চেনডাইজ চুক্তি সম্পাদনের বিষয়টি নৈতিকতার দিক থেকেও সমালোচিত হয়েছে। সমালোচকরা নীতিগত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাতে অবশ্য প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারর কিছু যায় আসে না। তাঁরা ঠিকই লোভনীয় সব সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের ব্যবসায়িক পোর্টফোলিও সমৃদ্ধ করে চলেছেন। সেই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাঁদের সম্পদের পরিমাণও।
শুক্রবার (১৩ জুন) প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই জানিয়েছেন, ২০২৪ সালে বিভিন্ন লাইসেন্সিং চুক্তি থেকে তিনি ৮ মিলিয়ন ডলার আয় করেছেন।
ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির ‘মেড ইন আমেরিকা’ স্মার্টফোন
সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকার বাজারে ‘মেড ইন আমেরিকা’ বা আমেরিকায় তৈরি স্মার্টফোনের ওপর জোর দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এটি তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিরই বহিঃপ্রকাশ। আমেরিকায় স্মার্টফোন তৈরি বিষয়টিকে ট্রাম্প এতটাই গুরুত্ব দিচ্ছেন যে, গত মাসেই তিনি অ্যাপল ও স্যামসাংকে হুমকি পর্যন্ত দিলেন, বিদেশে তৈরি স্মার্টফোন আমদানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
এই প্রেক্ষাপটেই ট্রাম্পের প্রতিষ্ঠান এবার ‘ট্রাম্প মোবাইল’ নিয়ে আসার ঘোষণা দিল। আর তাই এখানে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, আসন্ন টি১ স্মার্টফোনটিকে ‘মেড ইন আমেরিকা’ ডিভাইস হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে।
ট্রাম্পের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান- দ্য ট্রাম্প অর্গানাইজেশন- মূলত রিয়েল স্টেট, বিলাসবহুল হোটেল ও গলফ রিসোর্ট ব্যবসার জন্য পরিচিত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাঁরা ডিজিটাল মিডিয়া ও ক্রিপ্টোকারেন্সিতেও বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া ট্রাম্প রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর তাঁর প্রতিষ্ঠান নতুন বিভিন্ন পণ্য নিয়ে এসেছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঘড়ি, স্নিকার্স (জুতো) ও বাইবেল। তবে টেলিকমিউনিকেশনস খাতে তাঁদের আগমনের কেন্দ্রে আছে মূলত একটি লাইসেন্সিং চুক্তি।
তথ্যসূত্র: ট্রাম্প মোবাইল ডট কম, সিএনবিসি, রয়টার্স, টাইমস অব ইন্ডিয়া