আবারও বিধ্বস্ত হলো স্পেসএক্সের স্টারশিপ মহাকাশযানের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ। জানুয়ারি’তে স্টারশিপ রকেটের সপ্তম উৎক্ষেপণটি ব্যর্থ হওয়ার পর এবারে অষ্টম পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণটিও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে স্টারশিপ রকেটের ওপরের অংশটি (যার নামও স্টারশিপ)। তবে নিরাপদে ও সফলভাবে উৎক্ষেপণ প্যাডে ফিরে এসেছে ‘সুপার হেভি’ বুস্টার নামে পরিচিত রকেটটির নিচের অংশ বা প্রথম ধাপ (ফার্স্ট স্টেজ)।
বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) টেক্সাসের বোকা চিকায় অবস্থিত স্পেসএক্সের বিস্তৃত রকেট ফ্যাসিলিটির উৎক্ষেপণ প্যাড থেকে মহাকাশের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে স্টারশিপ রকেটটি। স্থানীয় সময় (ইস্টার্ন টাইম) সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টায়) উৎক্ষেপণ করা হয় এটি। উৎক্ষেপণের মোটামুটি ২ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড পর বুস্টারটি আলাদা হয়ে যায় স্টারশিপের মূল মহাকাশযান থেকে, যখন ভূমি থেকে রকেটটি ৬৫ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থান করছিল।
বুস্টার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর পৃথিবীর কক্ষপথের দিকেই উড্ডয়ন করছিল স্টারশিপ। অর্ধেক পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে ভারত সাগরের ওপর দিয়ে কক্ষপথে নিয়ন্ত্রিত প্রবেশের কথা ছিল মহাকাশযানটির। কিন্তু পূর্বদিকে অগ্রসর হওয়ার সময়ই বাঁধে বিপত্তি।
ভূমি থেকে উৎক্ষেপণের আনুমানিক ৮ মিনিট ১৩ সেকেন্ডের মাথায় প্রায় ১৪৬ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার পর রকেটটির ইঞ্জিনগুলো একে একে বন্ধ হতে থাকে। এ সময় গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়াররা মহাকাশযানটির অ্যালটিটিউড কনট্রোলও (উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ) হারায় বলে স্পেসএক্সের লাইভস্ট্রিমের ধারাবিবরণীতে জানানো হয়।
লাইভস্ট্রিমে দেখা যায়, মহাকাশযানটির ইঞ্জিনগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং এটি মহাকাশে অনিয়ন্ত্রিতভাবে এলোমেলো ঘুরপাক খাচ্ছে। এক পর্যায়ে গ্রাউন্ড স্টেশনের সাথে পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যানটি। উল্লেখ্য, স্টারশিপের অষ্টম পরীক্ষামূলক ফ্লাইটটি এক ঘন্টা স্থায়ী হওয়ার কথা থাকলেও উৎক্ষেপণের মাত্র ৯ মিনিট পরই মহাকাশযানটির নিয়ন্ত্রণ হারায় স্পেসএক্সের গ্রাউন্ড স্টেশন।
তাৎক্ষণিক বিবৃতিতে স্পেসএক্স জানিয়েছে, ‘স্টারশিপের (মূল মহাকাশযান) আরোহণের সময়, এটি অপ্রত্যাশিতভাবে দ্রুত ভেঙে যায় এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।’
স্পেসএক্সের স্টারশিপ রকেট সিস্টেমের এবারের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণটি বিশেষ একটি কারণে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এবারই প্রথম স্টারশিপ রকেটে পেলোড পাঠানো হয়। পেলোড হিসেবে এতে ছিল স্টারলিংকের ৪টি ডামি বা মক স্যাটেলাইট, যেগুলো পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপনের কথা ছিল মহাকাশযানটির। কিন্তু কক্ষপথে পৌঁছানোর আগেই ডামি (মডেল) স্যাটেলাইটসহ মহাকাশেই বিধ্বস্ত হয় স্টারশিপ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিও’তে দেখা যায়, স্টারশিপ মহাকাশযানটির ধ্বংসাবশেষ দক্ষিণ ফ্লোরিডা ও বাহামাসের নিকটবর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছে। আগুনসদৃশ ধ্বংসাবশেষের কারণে সন্ধ্যার আকাশ আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠে। তবে হতাহত বা কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতির খবর এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
মহাকাশযানটির ধ্বংসাবশেষ যাতে কোনো দুর্ঘটনার কারণ না হয় সেজন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আমেরিকার ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিকটবর্তী মায়ামি, ফোর্ট লোউডারডেল, পাম বিচ ও অরল্যান্ডো এয়ারপোর্টে স্থানীয় সময় রাত ৮টা পর্যন্ত বিমান উড্ডয়ন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়।
সুপার হেভি বুস্টারের সফল অবতরণ
স্টারশিপ মহাকাশযানটি কক্ষপথে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলেও সফলভাবেই উৎক্ষেপণ প্যাডে অবতরণ করতে পেরেছে এর ‘সুপার হেভি’ বুস্টারটি। মূল মহাকাশযান থেকে আলাদা হওয়ার পর ‘সুপার হেভি’ বুস্টার টেক্সাসের উৎক্ষেপণ প্যাডের দিকে অবতরণ করতে শুরু করে। উৎক্ষেপণ প্যাডের মেকানিক্যাল আর্মে নিয়ন্ত্রিত অবতরণ করাতে স্পেসএক্সের গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়াররা বুস্টারটির ইঞ্জিনগুলোকে পর্যায়ক্রমে বন্ধ করতে থাকে। এতে করে এর অবতরণের গতি কমে আসে। মেকানিক্যাল আর্ম দুটি বুস্টারটিকে ‘ক্যাচ’ ধরার সময় এর মাত্র ৩টি ইঞ্জিন চালু ছিল।
ভূমি থেকে রকেটটি উৎক্ষেপণের মোটামুটি ৭ মিনিট ২ সেকেন্ড পর বুস্টারটিকে উৎক্ষেপণ প্যাডের মেকানিক্যাল আর্মে নিয়ন্ত্রণ অবতরণ করাতে সমর্থ হয় ইঞ্জিনিয়াররা। অর্থাৎ, স্টারশিপের মূল মহাকাশযান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রায় ৪ মিনিট ১৭ সেকেন্ড পর বুস্টারটি উৎক্ষেপণ প্যাডে ফিরে আসে।
উল্লেখ্য, স্পেসএক্স-এর তৈরি স্টারশিপ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী রকেট সিস্টেম হিসেবে বিবেচিত। তবে স্টারশিপ এখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে প্রথম পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণের পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৮ বার উৎক্ষেপণ করা হয়েছে রকেটটি।
স্টারশিপ রকেটের এই উৎক্ষেপণগুলোতে ব্যর্থতার পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সাফল্যও পেয়েছে ইলন মাস্কের মালিকানাধীন মহাকাশ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স। তবে ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে স্টারশিপ রকেটের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রক্রিয়ায় স্টারশিপ রকেট সিস্টেমকে আরো উন্নত, নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য করে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ২০২৫ সালে এর পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণের সংখ্যা বৃদ্ধির কথা জানিয়েছেন মাস্ক।
তবে বছরের শুরুতেই পর পর দুটি পরীক্ষামূলক ফ্লাইট ব্যর্থ হওয়ায় স্টারশিপ রকেটের উন্নয়ন প্রক্রিয়াটি এখন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। মাস্কের মঙ্গল অভিযানের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার কেন্দ্রে রয়েছে এই স্টারশিপ রকেট সিস্টেম। উপরন্তু, আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসাও চলতি দশকের শেষ নাগাদ চন্দ্রপৃষ্ঠে নভোচারী পাঠাতে চায় স্টারশিপ রকেটে করেই। এছাড়া কক্ষপথে বড় আকারের পেলোড (যেমন স্যাটেলাইট) প্রেরণের মতো বাণিজ্যিক কাজেও স্টারশিপ রকেট ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে স্পেসএক্সের।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, ইউরোনিউজ