সোভিয়েত রাশিয়ার পতন হয়েছে সেই ১৯৯১ সালে। কিন্তু সোভিয়েত আমলের একটি মহাকাশযান এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে মহাকাশে। এবার এই মহাকাশযানের একটি অংশই সুদীর্ঘ ৫৩ বছর মহাশূন্যে কাটানোর পর চলতি সপ্তাহে পৃথিবীতে ফিরে আসতে যাচ্ছে। সম্প্রতি এমনটাই জানিয়েছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা।
‘কসমস ৪৮২’ নামের মহাকাশযানটি শুক্র গ্রহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে ১৯৭২ সালে। শুক্র গ্রহ অন্বেষণ মিশনের অংশ হিসেবে একে মহাকাশে পাঠায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। নাসা’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুক্র পৃষ্ঠে অবতরণের লক্ষ্য থাকলেও দুর্ভাগ্যবশত পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথও অতিক্রম করতে পারেনি এটি। শুধু তাই নয়, নিম্ন কক্ষপথেই মহাকাশযানটি চার টুকরো হয়ে যায়।
মহাকাশযানের চারটি টুকটোর একটি এবার পৃথিবীর দিকে ফিরে আসছে বলে জানিয়েছে নাসা। ধারণা করা হচ্ছে এই টুকরোটি হচ্ছে মহাকাশযানের ল্যান্ডার প্রোব। উল্লেখ্য, ল্যান্ডার প্রোব হচ্ছে গবেষণার উদ্দেশ্যে অন্য গ্রহের পৃষ্ঠে অবতরণে সক্ষম মানবহীন নভোযান বা মহাকাশযান।
‘কসমস ৪৮২’ এর ল্যান্ডার ক্যাপসুলটি একটি শক্ত, গোলাকার বস্তু, যেটি ১ মিটার চওড়া এবং এর ওজন অর্ধটন। এটাকে এমনভাবেই তৈরি করা হয়েছিল যাতে করে এটি শুক্রের প্রচণ্ড তাপ ও চাপ সহ্য করে টিকে থাকতে পারে। এজন্যই এতে রয়েছে শক্তিশালী হিট শিল্ড (তাপপ্রতিরোধী ঢাল) এবং এর গঠন যথেষ্ট টেকসই।
নাসা বলছে, ‘কসমস ৪৮২’ মহাকাশযানের এই অংশটি আনুমানিক আগামী ১০ মে তারিখে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে পারে। অর্থাৎ, অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় মহাকাশে কাটিয়ে এবার পৃথিবীতে অবতরণ করতে চলেছে এটি। পৃথিবীতে ফিরে আসতে আসতে এর একটি বড় অংশই আগুনে পুরে যাওয়ার কথা। তবে নাসা আশা করছে এর কিছু অংশ অন্তত অক্ষত থাকবে।
নাসাসহ বিভিন্ন মহাকাশ সংস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ‘কসমস ৪৮২’ মহাকাশযানের অংশটিকে। তবে এই বস্তুটি পৃথিবীর ঠিক কোথায় অবতরণ করতে পারে সে সম্পর্কে এখনও সুস্পষ্ট কোনো ধারণা দিতে পারেনি মহাকাশ সংস্থাগুলো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অর্ধটন ওজনের এই টুকরোটির আঘাতে পৃথিবীবাসীর ক্ষতির সম্ভাবনা কতটুকু।
এক্ষেত্রে অবশ্য আশার বাণীই শোনাচ্ছেন ইউরোপিয়ান মহাকাশ সংস্থার মহাকাশযান ধ্বংসাবশেষ বিষয়ক বিশ্লেষক স্টিজিন লেমেনস। একজন ব্যক্তির লটারি জেতার সম্ভাবনা যতটুকু মহাকাশযানের এই টুকরোর আঘাতে ক্ষতির সম্ভাবনা ততটুকোই দেখছেন তিনি।
ভূপৃষ্ঠে থাকা জনবসতির ক্ষতির সম্ভাবনা খুবই কম। ল্যান্ডার ক্যাপসুলটি ৫১.৭ ডিগ্রি উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে যেকোনো স্থানে অবতরণ করতে পারে। সে হিসেবে এর সম্ভাব্য অবতরণক্ষেত্র হতে পারে উত্তরে লন্ডন থেকে শুরু করে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ প্রান্তের মধ্যকার যেকোনো অঞ্চল।
উল্লেখ্য, এই মহাকাশযানটি’তে প্যারাসুট সিস্টেমও সন্নিবেশিত ছিল, যাতে করে শুক্র পৃষ্ঠে এটি নিরাপদে অবতরণ করতে পারে। কিন্তু গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় মহাকাশে থাকায় এর প্যারাসুট সচল ও কার্যকর থাকায় কথা নয়। ফলে এর নিয়ন্ত্রিত অবতরণের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
তবে অনিয়ন্ত্রিত অবতরণ করলেও সোভিয়েত আমলের মহাকাশযানটির ধ্বংসাবশেষটির হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। কেননা মানুষের বসতি আছে এমন অঞ্চলেই এর অবতরণের সম্ভাবনা রয়েছে।
মহাকাশ থেকে পৃথিবীর বুকে বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষের অনিয়ন্ত্রিত অবতরণ অবশ্য নতুন কিছু নয়। প্রতি সপ্তাহেই বড় কোনো মহাকাশযানের ধ্বংসাবশেষ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে চলে আসে, আর ছোট মহাকাশযানের ক্ষেত্রে এমনটা বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই ঘটে থাকে।
উদাহরণস্বরূপ, চীনের লং মার্চ ৫বি বুস্টার ভারত সাগরের ওপরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুনঃপ্রবেশ করে ২০২২ সালে, এবং তাঁদের তিয়ানগং-১ মহাকাশ স্টেশন প্রশান্ত মহাসাগরের ওপরে প্রায় পুরোপুরি পুড়ে যায় ২০১৮ সালে। উল্লেখ্য, পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে পতনের আগে বায়ুমণ্ডলেই এই বস্তুগুলো সাধারণত আগুনে পুড়ে যায়।
তথ্যসূত্র: বিবিসি