জনপ্রিয় ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা পাভেল দুরভ সম্প্রতি বলেছেন, তিনি তাঁর মোট সম্পদের পুরোটাই সন্তানদের মাঝে সমানভাবে ভাগ করে দিয়ে যাবেন, যাতে করে তাঁর মৃত্যুর পর সম্পদের ভাগাভাগি নিয়ে সন্তানদের মাঝে কলহের সৃষ্টি না হয়। বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) ফ্রেঞ্চ ম্যাগাজিন লা পয়েন্টে প্রকাশিত পাভেল দুরভের এক সাক্ষাৎকার থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
দুরভের সম্পদের পরিমাণ বেশি নয়, মাত্র ১৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, বাংলাদেশী মুদ্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকারও বেশি! আর সন্তানের সংখ্যা? সেটাও সামান্যই- ১০০’র কিছু বেশি! শেষের এই সংখ্যাটায় অনেকেরই চোখ যে কপালে উঠবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
একজন ব্যক্তির এতগুলো সন্তান হয় কী করে- এমন জিজ্ঞাসার উদ্রেক হয়েছে যাদের মনে, তাঁদের জন্য বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যার দাবি রাখে। লা পয়েন্টকে সে ব্যাখ্যা দিয়েছেনও রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে জন্ম নেওয়া পাভেল দুরভ।
সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন যে, ৩ জন ভিন্ন সঙ্গীর (পার্টনারের) সাথে তাঁর ৬টি সন্তান আছে। এই সন্তানদের ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে ‘অফিশিয়াল ফাদার’ অ্যাখ্যা দিয়েছেন! তবে এঁদের বাইরেও তাঁর ১০০-এরও বেশি সন্তান রয়েছে বলে জানিয়েছেন দুরভ। সেটা কীভাবে?
লা পয়েন্টকে দুরভ বলেছেন যে, এক বন্ধুকে সহায়তার জন্য তিনি ১৫ বছর আগে থেকেই একটি ক্লিনিকে স্পার্ম ডোনেট (শুক্রাণু দান) করে আসছেন। সেই ক্লিনিক তাঁকে জানিয়েছে, এই পদ্ধতিতে ১২টি দেশে ১০০’রও বেশি শিশু জন্মগ্রহণ করেছে। এঁদের সবাইকেই তিনি তাঁর সম্পদের অংশ ভাগ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
লা পয়েন্ট ম্যাগাজিনকে দুরভ বলেন, ‘তাঁরা সকলেই আমার সন্তান এবং (আমার সম্পদে) তাঁদের সকলেরই সমান অধিকার থাকবে।’
তবে দুরভ এও জানিয়েছেন, তাঁর সন্তানেরা ৩০ বছরে পদার্পণের আগে তাঁর সম্পদ ভোগ করতে পারবেন না। কেননা তিনি চান তাঁর সন্তানেরা তাঁর অর্জিত সম্পদের ওপর নির্ভর না করে সাধারণ জীবনযাপন করুক এবং স্ব-নির্ভর হয়ে উঠুক।
তিনি বলেন, ‘আমি চাই তারা একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের উপর নির্ভরশীল না হয়ে স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনযাপন করুক, একাই নিজেদের গড়ে তুলুক, নিজেদের উপর আস্থা রাখতে শিখুক, (নতুন কিছু) সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়ে উঠুক।’
ফ্রেঞ্চ ম্যাগাজিনের সাথে আলাপচারিতায় ৪০-বছর-বয়সী এই প্রযুক্তিবিদ তাঁর মালিকানাধীন টেলিগ্রাম অ্যাপ নিয়েও কথা বলেছেন। মাসিক ১০০ কোটিরও বেশি ব্যবহারকারীর প্ল্যাটফর্ম টেলিগ্রাম অ্যাপটি ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা ও মেসেজ এনক্রিপশন প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য সাধারণ ব্যবহারকারীদের মাঝে দারুন জনপ্রিয়।
তবে টেলিগ্রামের এই সুবিধার সুযোগ নিয়ে অনেকেই অ্যাপটিকে অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মাদক চোরাচালান ও প্রতারণার মতো অপরাধ সংঘটনে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহারের কথা জানিয়েছে ফ্রান্স ও রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের আইন প্রয়োগকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়া অভিযোগ আছে, অ্যাপটিতে অবাধে শেয়ার করা হয় শিশুদের যৌন নির্যাতন সম্পর্কিত কনটেন্ট।
শুধু তাই নয়, টেলিগ্রাম অ্যাপটিতে ‘সঠিকভাবে মডারেট’ না করার অভিযোগে গত বছর ফ্রান্সে গ্রেপ্তার পর্যন্ত হয়েছিলেন দুরভ। স্বেচ্ছা-নির্বাসিত দুরভ বর্তমানে দুবাইতে অবস্থান করলেও তাঁর বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ এখনও ফ্রান্সের আদালতে বিচারাধীন আছে। তবে লা পয়েন্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দুরভ তাঁর বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগকেই ‘পুরোপুরি অযৌক্তিক’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘অপরাধীরা অন্য অনেকের মতো আমাদের মেসেজিং সেবা ব্যবহার করে বলেই যারা এই প্ল্যাটফর্মটি পরিচালনা করে তাঁরা অপরাধী হয়ে যায় না।’
তবে এসব অভিযোগের বাইরেও আরেকটি কারণে টেলিগ্রাম অ্যাপটি রাশিয়ার মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রের ‘চোখের বালি’-তে পরিণত হয়েছে। আর তা হচ্ছে, রাজনৈতিক ভিন্নমত পোষণ করেন এমন ব্যক্তিরা নিরাপদে নিজেদের মত প্রকাশ করার ও নিজেদেরকে সংগঠিত করতে টেলিগ্রাম ব্যবহার করে থাকেন।
যেহেতু অ্যাপটিতে এন্ড-টু-এন্ড মেসেজ এনক্রিপশন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় তাই সরকার চাইলেও টেলিগ্রামের মেসেজ অ্যাক্সেস করতে পারে না। এছাড়া দুরভের প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে, ফলে ব্যবহারকারীদের কোনো তথ্যই তাঁরা সরকারের সাথে শেয়ার করে না। আর এ কারণেই রাশিয়াসহ বেশ কিছু দেশে সরকার বিরোধীদের মাঝে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে টেলিগ্রাম এবং স্বাভাবিকভাবে সরকারের লক্ষ্যবস্তুততে পরিণত হয়েছে প্ল্যাটফর্মটি।
বিশ্বের আলোচিত প্রযুক্তিবিদ পাভেল দুরভ ভালো করেই জানেন নিজের কাজের মাধ্যমে তিনি শক্তিশালী অনেকেরই শত্রুতে পরিণত হয়েছেন। নিজের জীবনশঙ্কার কথা বিবেচনা করেই তিনি সন্তানদের নামে একটি উইল তৈরি করেছেন বলেও জানিয়েছেন লা পয়েন্টকে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি