পাকিস্তানের লাহোরে আজ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যেখানে লড়ছে নিউজিল্যান্ড-সাউথ আফ্রিকা, গ্যালারিতে প্রায় অধিকাংশ আসনই ফাঁকা। কারণটাও অবশ্য অজানা নয়, স্বাগতিক দেশ যে এই টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছে। ফলে সমর্থকদের এই ম্যাচে আগ্রহ থাকবেই-বা কীভাবে?
দীর্ঘ ২৯ বছর পর পাকিস্তানের মাটিতে আইসিসি ইভেন্ট আয়োজিত হচ্ছে অথচ প্রথম দুই ম্যাচ হেরে স্বাগতিক দেশই সবার আগে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছে। আইসিসি ইভেন্টে পাকিস্তানের এমন পারফরম্যান্স অবশ্য এই প্রথমই নয়। সর্বশেষ দুইটি বিশ্বকাপেও সমর্থকদের প্রত্যাশা মেটাতে পারেনি পাকিস্তান।
ঠিক কী কারণে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে পাকিস্তানের ক্রিকেট? এমন প্রশ্ন এখন চারিদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেশটির সাবেক ক্রিকেটাররা তো বোর্ডের কর্মকর্তাদের একেবারে ধুয়েই দিচ্ছেন। বাজে পারফরম্যান্সের কারণে এমন সমালোচনার মুখে পিসিবি এর আগেও পড়েছে ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ ও ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর।
সমালোচনার ফলাফল প্রতিবারই যা দাঁড়িয়েছে, তা হলো অধিনায়ক, কোচ, দলের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের পরিবর্তন। সর্বোচ্চ হলে বোর্ড প্রধানের পদত্যাগ। এসব কিছু করেও বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি দেশটির ক্রিকেটে।
পাকিস্তানের ক্রিকেটে এমন অধপতনের পেছনে অবশ্য দায়ী দেশটির বোর্ডে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। রাজনৈতিক পরিবর্তন এলেই দেশটির ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান বদলে যায়। সেই সঙ্গে বাজে পারফরম্যান্সের দায়ে পূর্ণ মেয়াদ শেষ করার আগে পিসিবি চেয়ারম্যানের পরিবর্তন তো আছেই।
২০২২ সালে তৃতীয় মেয়াদে পিসিবি প্রধানের দায়িত্ব নেওয়া নাজাম শেঠী তো বলেই দিয়েছিলেন পাকিস্তানের ক্রিকেটে অধপতন শুরু হয়েছে ২০১৯ সাল থেকে (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আমলে)।
দায়িত্বে এসে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নাজাম শেঠী দায়ী করলেও তাঁর অধীনেও পিসিবিতে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। উল্টো বিতর্ক বেড়েছে সাবেক ক্রিকেটারদের এক দায়িত্ব দেওয়ার পর তা থেকে সরিয়ে আরেকটি দায়িত্ব দেওয়ায়। যার শুরুটা হয়েছিল ওয়াকার ইউনূসকে পিসিবি চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা বানানোর তিন সপ্তাহ পরই ঘরোয়া ক্রিকেটের একটি দলের মেন্টর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে।
এমনকি চলতি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির দল নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। ফাহিম আশরাফ ও খুশদীল শাহর স্কোয়াডে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সমালোচনা হয়েছে অনেক। অনেকে তো দাবিই করে বসেছেন ফাহিম আশরাফ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে দলে জায়গা পেয়েছেন।
এসব বিতর্কের মাঝেও সবচেয়ে বড় ধাক্কা পাকিস্তান ক্রিকেটে ঘন ঘন অধিনায়ক, কোচ ও বোর্ড প্রধান পরিবর্তন। ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৬ জন বোর্ড প্রধান দায়িত্ব সামলেছেন। আর অধিনায়ক পরিবর্তন তো একেকটি আইসিসি ইভেন্টে ব্যর্থ মিশন শেষে অভ্যাসেই পরিণত হয়েছে। ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর তিন ফরম্যাট থেকে অধিনায়কের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান বাবর আজম।
এরপর শাহিন শাহ আফ্রিদিকে টি-টোয়েন্টির দায়িত্ব দিয়ে ফের বিশ্বকাপের আগে বাবর আজমের কাছেই অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড ফিরিয়ে দেয় পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর ফের দায়িত্ব ছাড়েন বাবর। এ যেন রদবদলের খেলা।
২০২৩ সাল থেকে বর্তমান বোর্ড প্রধান মহসিন নাকভি পর্যন্ত চেয়ারম্যানই বদলেছে মোট তিনবার। সেই সংখ্যাটা কোচদের ক্ষেত্রে ১১ জন। অন্তর্বর্তীকালীন কোচ থেকে ধরে প্রধান কোচ পর্যন্ত মোট ১১ জন ২০২৩ থেকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তান ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটের দায়িত্ব সামলেছেন।
যতবারই দেশটির কোচ থেকে ধরে ম্যানেজমেন্ট বদল হয়েছে ততবারই ক্রিকেটার থেকে ধরে অবকাঠামো সব জায়গাতেই পরিবর্তন আনা হয়েছে।
ক্রিকেটের মাঠে আনপ্রেডিক্টেবল খ্যাত পাকিস্তান ক্রিকেটের বাইরে এখন আলোচনা তৈরি করেছে শুধুই তাদের বারবার নিয়মনীতি ও দায়িত্বশীল জায়গায় পরিবর্তন আনার জন্য। যার ফলাফল মাঠের ক্রিকেটে খুব খারাপভাবেই পড়েছে।
২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলার পর থেকে আইসিসির তিনটি ইভেন্টে পাকিস্তান গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়েছে। সর্বশেষ তিন বছরে পাকিস্তানের ক্রিকেটের এমন ভরাডুবির পেছনে সাবেক ক্রিকেটাররা ম্যানেজমেন্ট দায়ী করছেন।
এমনকি পাকিস্তানের সাবেক পেসার শোয়েব আখতার তো বোর্ড প্রধানের পদটিকেই ধুয়ে দিয়েছেন। সম্প্রতি একটি টেলিভিশন শোতে সাবেক এই পেসার বলেন, ‘পাকিস্তানের বোর্ড প্রধানের চেয়ারে যারা বসছেন তাঁদের কে কতটুকু ক্রিকেট সম্বন্ধে জ্ঞান রাখে। ওনাদের কী ক্রিকেটীয় পরিচয় আছে?’
শোয়েব আখতারের এমন মন্তব্য মূলত দেশটির ম্যানেজমেন্টের দিকে প্রশ্ন তুলেছে তা নয়। পাকিস্তান সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের দিকেও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
সাবেক ক্রিকেটার রমিজ রাজা পিসিবির দায়িত্ব সামলেছিলেন ২০২১ থেকে ২০২২ পর্যন্ত। দেশটির সরকার পরিবর্তন হওয়ায় রমিজ তাঁর মেয়াদের দুই বছর আগেই সরে দাঁড়ান। প্রতিবারই ম্যানেজমেন্ট বদলেছে দেশটির অধিনায়ক,কোচ ও বোর্ডে বদল এসেছে।
এমন ঘন ঘন পরিবর্তন দেখে সাবেক অধিনায়ক ওয়াসিম আকরাম বলেই দিয়েছেন তিনি ফ্রিতে দরকার পড়লে পাকিস্তানের ক্রিকেটে সহায়তা করবেন তবে কোনো প্রকার পদে থেকে কিছুই করবেন না। কারণ হিসেবে জানিয়েছেন, এসব পদে গেলেই অপমানের শিকার হতে হয়। তার থেকে দূরে বসে সহায়তা করাটাই শ্রেয় মনে করেন তিনি।
ধুঁকতে থাকা পাকিস্তানের ক্রিকেটের কে হাল ধরবেন তা সময়ই বলে দিবে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি থেকে দ্রুত বিদায়ের পর পাকিস্তানের টি-টোয়েন্টি দল থেকে বাদ পড়েছেন মোহাম্মদ রিজওয়ান ও বাবর আজমের মতো তারকারা। পিসিবি থেকে নিউজিল্যান্ড সিরিজের জন্য টি-টোয়েন্টির নতুন অধিনায়ক করা হয়েছে সালমান আলী আঘাকে। অথচ এতদিন রিজওয়ান ছিলেন সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের অধিনায়ক।
আরেক আইসিসি ইভেন্টে বিদায়ের পর আরেকবার অধিনায়ক বদল, পাকিস্তানের ক্রিকেটের এই প্রক্রিয়া যেন আর থামবার নয়।