দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য অপেক্ষাটা ছিল ২৭ বছরের। ১৯৯৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির শিরোপা ঘরে তুলেছিল প্রোটিয়ারা। তখন অবশ্য এ টুর্নামেন্টের নাম ছিল আইসিসি নকআউট ট্রফি।
সেবারই শেষ। এরপর একটা করে আইসিসি টুর্নামেন্ট গিয়েছে, আর প্রত্যেকবারই শিরোপার খালিহাতে ফিরতে হয়েছে প্রোটিয়াদের। দুর্দান্ত প্রতাপে টুর্নামেন্ট শুরু করার পর একেবারে শেষ মুহূর্তে গিয়ে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেছে বারবার। নামের পাশে ‘চোকার’ শব্দটা তো সমার্থকই বানিয়ে ফেলেছিল সাউথ আফ্রিকা।
অবশেষে ৯৭২২ দিনের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হয়েছে গতকাল শনিবার। লর্ডসে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ‘টেস্ট বিশ্বকাপের’ শিরোপা জিতেছে সাউথ আফ্রিকা। পাশাপাশি নামের পাশ থেকে চোকার শব্দটাকেও বিদায় করার উপলক্ষ্য পেয়েছে।
সাউথ আফ্রিকার টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাফল্যের এ দিনটার দেখা পেয়েছে টেম্বা বাভুমার হাত ধরে। শুধু নামেই অধিনায়ক নয়, বরং ফাইনালেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন নামের মধ্যে আশা সঙ্গী করে চলা বাভুমা। শিরোপার সমীকরণ মেলাতে যখন চতুর্থ ইনিংসে ২৮২ রান দরকার, এমন পরিস্থিতিতে ৬৬ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেছেন, সেটাও আবার হ্যামস্ট্রিংয়ের ব্যথা সামলে। ওপেনার এইডেন মার্করামের (১২৮) সঙ্গে তৃতীয় উইকেটে ১৪৭ রানের জুটি গড়ে সাউথ আফ্রিকার জয়ের পথ সহজ করেছেন।
শুধু তাই নয়, প্যাট কামিন্স-মিচেল স্টার্কদের তোপে প্রথম ইনিংসে সাউথ আফ্রিকা যে ১৩৮ রান করতে পেরেছিল, সেখানেও ৩৬ রান বাভুমার। লর্ডসে এমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্স উপহার দিয়ে সাউথ আফ্রিকায় রীতিমতো জাতীয় হিরো বনে গেছেন ৩৫ বছর বয়সী এ ডানহাতি ব্যাটসম্যান। অথচ একটা সময় লর্ডসে খেলা তাঁর জন্য ছিল স্বপ্নের মতোই।
কেপটাউনের কাছাকাছি লেঙ্গা (যার অর্থ সূর্য) শহরতলিতে বেড়ে ওঠা বাভুমা টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের আগে ছোটবেলার সে স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। সাউথ আফ্রিকার ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এ অধিনায়ক বলেছেন, ‘লেঙ্গায় বেড়ে ওঠার সময়কাল থেকেই লর্ডসের প্রতি আলাদা টান অনুভব করতাম। লেঙ্গায় (বাড়ির পাশে) চার রাস্তার একটা মোড় ছিল। ওখানে ডানদিকের রাস্তাটা খুব একটা ভালো ছিল না। ওটাতে বল অদ্ভুতরকমের বাউন্স করত। তাই আমরা ওটার নাম দিয়েছিলাম করাচি। বাঁ দিকের রাস্তাটার নাম দিয়েছিলাম এমএসজি (মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড)।’
তবে এ দুটো রাস্তা খেলার জন্য পছন্দের ছিল না বাভুমার জন্য। তিনি বেশি খেলতে পছন্দ করতেন অন্য আরেকদিকের রাস্তায় খেলতে। ওই রাস্তাটা ছিল সমান। বাভুমার ভাষায়, ‘(খেলার জন্য) আমার সবচেয়ে পছন্দের রাস্তাটা ছিল পরিষ্কার আর সাজানো গোছানো। অন্য রাস্তাগুলোর তুলনায় ভালো ছিল বলে ওটাকে আমরা লর্ডস নামে ডাকতাম। অর্থাৎ ১০ বছর বয়স থেকেই আমি লর্ডসে খেলার স্বপ্ন দেখতাম।’
যে ভেন্যুর ২২ গজে ব্যাটিং করার স্বপ্ন দেখে বেড়ে উঠেছেন, সেখানে বাভুমার হাত ধরে ইতিহাস লেখা হয়ে গেল সাউথ আফ্রিকার।
শুনতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, বাভুমার পথচলা এতটা মসৃণ ছিল না। ২০১৪ সালে টেস্ট অভিষেক, দুবছর পর দেশটির ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে টেস্টে সেঞ্চুরি, আরও ৬ বছর পর প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে প্রোটিয়াদের অধিনায়কত্বের ভার।
দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময়ের ক্যারিয়ারে উত্থান-পতন কম দেখেননি। যখন বাভুমা প্রোটিয়াদের জার্সি গায়ে তোলেন, সে সময় আইসিসি টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে সবার ওপরে ছিল সাউথ আফ্রিকা। সে সময় তারকায় ঠাসা সাউথ আফ্রিকার ব্যাটিংয়ে ছিল ফাফ ডু প্লেসি-হাশিম আমলা-এবি ডি ভিলিয়ার্সদের মতো তারকাদের নাম। একটা পর্যায়ে অবসর নেন তারা। তাদের জায়গা দলে একে একে যুক্ত হন এইডেন মার্করাম-উইয়ান মুল্ডাররা।
একদিকে ডু প্লেসি-ডি ভিলিয়ার্সদের শূন্যতা পূরণ, অন্যদিকে মার্করাম-মুল্ডারদের অধারাবাহিক পারফরম্যান্স- দুই অবস্থাতেই নীরবে মিডল অর্ডারে নিজের দায়িত্ব সামলে গেছেন বাভুমা। তাঁকে স্যান্ডউইচের মাঝের অংশটা বললেও বোধহয় খুব বেশি ভুল হবে না।
৬৪ ম্যাচের টেস্ট ক্যারিয়ার শেষে বাভুমার নামের পাশে ২৫ ফিফটি আর ৪ সেঞ্চুরিতে ৩৭০৮ রান। গড় ৩৮.২২। তবে যদি ২০২১ সাল থেকে বিবেচনা করা হয়, তাহলে গড় বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯.৭৭!
টেস্টে নীরবে যে শুধু ব্যাটিংটা সামলে গেছেন, এমন নয়। অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর সেটাও সামলেছেন দারুণ দক্ষতায়। ২০২৩ সালে ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে প্রথমবারের মতো সাউথ আফ্রিকাকে নেতৃত্ব দেন বাভুমা। দুটি ম্যাচেই জেতে প্রোটিয়া। একই বছরের শেষ ভাগে কেপটাউনে ভারতকে হারায় সাউথ আফ্রিকা। কিন্তু চোটের কারণে ওই টেস্টের একাদশে থাকলেও মাঠে নামতে পারেননি বাভুমা।
এরপর এসএ-টোয়েন্টির সঙ্গে সূচি সাংঘর্ষিক হওয়ায় নিউজিল্যান্ড সফরে দ্বিতীয় সারির দল পাঠায় সাউথ আফ্রিকা। অনুমিতভাবে ওই সিরিজের দলে ছিলেন না বাভুমা। পরের বছরের আগস্টে আবারও টেস্টে অধিনায়ক প্রত্যাবর্তন হয় বাভুমার। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওই সিরিজের প্রথম ম্যাচটা বৃষ্টির বাগড়ায় ড্র হলে চার ম্যাচের অধিনায়কত্ব ক্যারিয়ার শেষে বাভুমার নামের পাশে ৩ জয় আর ১ ড্র।
ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে পরের টেস্টে জয় দিয়ে শুরু, বাভুমার নেতৃত্বে সাউথ আফ্রিকা একে একে সিরিজ জিতেছে শ্রীলঙ্কা আর পাকিস্তানের বিপক্ষে। নিশ্চিত করে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের টিকিট। প্রোটিয়াদের জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে লর্ডসের শিরোপা নির্ধারণীতেও। তাতে একদিকে সাউথ আফ্রিকার ২৭ বছরের অপেক্ষার যেমন অবসান হয়েছে, তাতে অধিনায়ক হিসেবেও নতুন মাইলফলক গড়েছেন বাভুমা।
অধিনায়ক হিসেবে ১০ টেস্টের ক্যারিয়ারে ৯টিতেই জয়ের দেখা পেয়েছেন বাভুমা। এর আগে এমন কীর্তি গড়েছিলেন পারসি চাপম্যান। ১৯২৬ থেকে ১৯৩০ সালে চাপম্যানের নেতৃত্বে প্রথম ১০ টেস্টের ৯টিতে জিতেছিল ইংল্যান্ড। তবে একটা জায়গায় চাপম্যানকে ছাড়িয়ে গেছেন বাভুমা। ইংল্যান্ড অন্য ম্যাচটা হারলেও বাভুমার নেতৃত্বে সাউথ আফ্রিকা এখনো অপরাজিত!
এমন কীর্তি আর ক্রমাগত ব্যাটিং পারফর্ম করেও ‘কোটা’র ব্যাটসম্যানের খোটা প্রতিনিয়ত শুনতে হয়েছে বাভুমাকে। উচ্চতায় মোটে ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি, আগ্রাসী সতীর্থদের পাশাপাশি তাঁর ধীরস্থির ব্যাটিং মিলিয়ে মিম আর ট্রলও কম হয়নি তাঁকে নিয়ে। তবে সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে বাভুমাই এখন সাউথ আফ্রিকাকে সাফল্য এনে দেওয়ার নায়ক।
অথচ একটা সময় তাঁকে শুধু ক্রিকেট নিয়ে নয়, লড়তে হয়েছে শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতি বুঝতে পারা নিয়েও। ১০ বছর বয়সেই অমিত প্রতিভার জেরে সাউথ আফ্রিকার বিখ্যাত এসএসিএসে স্কলারশিপ পান বাভুমা। কিন্তু সেই স্কুলটা ছিল শুধু শ্বেতাঙ্গদের জন্য নির্ধারিত। সেখানে গিয়ে মানিয়ে নিতে কম বেগ পেতে হয়নি তাঁকে।
ওই সময়কার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বাভুমা বলেছেন, ‘ওই সিস্টেমের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া খুবই কঠিন ছিল। বিশেষ করে (শ্বেতাঙ্গদের) সংস্কৃতি বুঝতে পারা। তবে আমি একজন ক্রিকেটার হিসেবে সেখানে গিয়েছিলাম। তাই সহজেই শিখতে পেরেছিলাম। বন্ধু বানানোও সহজ ছিল। কিন্তু আমাকে শৃঙ্খলা আর শিষ্ঠাচার শিখতে হয়েছিল, যা ওই সংস্কৃতিতে খুবই বড় বিষয়।’
ধীরে ধীরে সব শিখলেও কৃষ্ণাঙ্গ বলে বাভুমার মনের ভেতর হীনম্মন্যতা কাজ করত সব সময়ই। এ প্রসঙ্গে বাভুমা বলেছেন, ‘কীভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে হয়, সেটা শিখতে হচ্ছিল। একটাবার চিন্তা করেন, লেঙ্গার একটা শিশুকে এমন একটা সিস্টেমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখানে সবকিছু (নিয়ম) মেনে করা হয়। সব সময় আমার মধ্যে একটা সন্দেহ কাজ করত। আমি কি এখানে থাকার যোগ্য? আমি কি এই সুযোগ পাওয়ার যোগ্য?’
শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বৈষম্য কতটা প্রকট ছিল ছোট বেলায়, সে স্মৃতি বলতে গিয়ে বাভুমা জানান, প্রাথমিকে পড়ার সময় তাঁর মোটে তিনজন কৃষ্ণাঙ্গ বন্ধু ছিল। প্রতিদিন তারা লেঙ্গা থেকে এসএসিএসে যাতায়াত করতেন। সে ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বাভুমা বলেছেন, ‘আমরা কিছুটা কম বুঝতাম। কিন্তু (আমাদের জন্য) বুঝতে কঠিন হলেও বৈষম্যটা স্পষ্ট ছিল।’
সে সময় সবকিছুতে বৈষম্য থাকলেও গতকাল দেশকে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা এনে দেওয়ার পর কোনো বিভেদের কথা তোলেননি বাভুমা, ‘এটা এ দল, দেশ আর আমার জন্য বিশেষ অর্জন।’
নামের পাশে চোকার তকমা ছিল বলে কিছুটা আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ছিল। এমনকি প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়াও মাঠে এ নিয়ে স্লেজিং করেছে। সেদিকে মাথায় না ঘামিয়ে নিজেদের কাজটা ঠিকঠাক করে গেছে প্রোটিয়ারা।
বাভুমার ভাষায়, ‘আমরা যখন ব্যাটিং করছিলাম, আমাদের ভয় ধরাতে অসিরা “চোক” শব্দটা ব্যবহার করছিল। আমরা এখানে (লর্ডসে) যেমন বিশ্বাস নিয়ে এসেছিলাম, তেমনি সংশয়ও কম ছিল না। আমরা ফাইনালে উঠেছিলাম বটে, কিন্তু আমাদের এ পথচলা (কম ম্যাচ খেলেছে বলে) নিয়ে (অনেকের) সন্দেহ ছিল। এ জয় সেই সন্দেহের দরজা ভেঙে দিয়েছে। আমরা জাতি হিসেবে যতই বিভক্ত থাকি না কেন, এটা আমাদের এক করার উপলক্ষ্য এনে দিয়েছে।’