২০১৬ কোপা আমেরিকা ফাইনালের ওই পেনাল্টি শ্যুটআউটের কথা মনে আছে? শিরোপা নির্ধারণী ওই ম্যাচে টাইব্রেকারে চিলির হয়ে নেওয়া আর্তুরো ভিদালের প্রথম শটটা ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার সে সময়ের গোলকিপার সের্হিও রোমেরো। এতে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ আসে আলবিসেলেস্তেদের সামনে। কিন্তু আকাশি-নীলদের হয়ে প্রথম শট নিয়ে গিয়ে পোস্টের অনেক ওপর দিয়ে মেরে বসেন লিওনেল মেসি।
আর্জেন্টাইন মহাতারকার অবিশ্বাস্য ওই মিসের পর মনোবল হারিয়ে ফেলে আর্জেন্টিনা। যার রেশে পরে পেনাল্টিতে গোল করতে ব্যর্থ হন লুকাস বিলিয়াও। তাতে টানা দ্বিতীয়বার কোপা আমেরিকার ফাইনালে স্বপ্নভঙ্গ হয় আর্জেন্টিনার। তার চেয়েও বড় ধাক্কা হয়ে আসে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে মেসির আচমকা অবসরের ঘোষণা।
অবশ্য অবসর ভেঙে মেসি ফিরেছেন। প্রত্যাবর্তনের পর শুরুর দিকটা হতাশাজনক হলেও পরে জাতীয় দলের হয়ে আক্ষেপের সবটা পূর্ণ করেছেন। দুটো কোপা আমেরিকা (২০২১ ও ২০২৪) জেতার মাঝে জিতেছেন বিশ্বকাপও। এ টুর্নামেন্টগুলোতে আর্জেন্টিনার ম্যাচ যতবার টাইব্রেকারে গড়িয়েছে, প্রতিবার প্রথম শটটাই নিয়েছেন মেসি। যার মধ্যে আছে কাতার বিশ্বকাপ ফাইনালের টাইব্রেকারে প্রথম শটটাও। প্রথম পেনাল্টি নেওয়ার ভয়াবহ ওই দুঃস্মৃতি থাকার পরও মেসি কেন প্রথমে শট নেন, এর ব্যাখ্যা নিজেই দিয়েছেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে মেসি জানিয়েছেন, সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতেই এ কাজ করেন তিনি। শুধু পেনাল্টি শ্যুট না, পাশাপাশি ২০২২ বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতা ও ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলার সম্ভাবনা নিয়েও কথা বলেছেন মেসি।
মেসি অবশ্য আর্জেন্টিনার জার্সিতে আগে থেকেই টাইব্রেকারের প্রথম শটটা নেন। ২০১১ কোপা আমেরিকার কোয়ার্টার ফাইনালে উরুগুয়ের বিপক্ষে টাইব্রেকারে প্রথম শটটা নিয়েছিলে মেসি। এরপর ২০১৪ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সেমিফাইনালেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। চিলির বিপক্ষে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে পরপর দুটি ফাইনালেও একই কাজ করেছেন তিনি।
তারই ধারাবাহিকতায় ২০২১ কোপা আমেরিকায় সেমিফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে, ২০২২ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডস ও ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে এবং ২০২৪ কোপা আমেরিকার কোয়ার্টার ফাইনালে ইকুয়েডরের বিপক্ষে টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনার প্রথম শটটা নেন মেসি।
কেন এমনটা করেন? এমন প্রশ্নের জবাবে সম্প্রতি সিমপ্লেমেন্তে ফুতবলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মেসি বলেছেন, ‘দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নিতেই পেনাল্টি শ্যুটআউটে সবসময় প্রথমে যেতে চেষ্টা করি। সবসময়ই আমি এটাই করেছি।’
কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে ফ্রান্সের উগো লরিসের বিপক্ষে মেসি যেভাবে শটটা নিয়েছিলেন, সেটা আর্জেন্টাইন সমর্থকদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। মেসি যেদিকে শট নিয়েছিলেন, সেদিকেই ঝাঁপিয়েছিলেন লরিস। অল্পের জন্য বলের নাগাল পাননি। অমন ঝুঁকিপূর্ণ শট প্রসঙ্গে মেসি বলেছেন, ‘আমি লরিসের বিপক্ষে কোনদিকে শট নেব, সেটা নিয়ে আগে থেকে কিছুই ভাবিনি। আমি ওর শেষ মুভমেন্টের অপেক্ষা করছিলাম। সে যখন সরে গেল, আমি খুবই শান্ত থেকেছি (শট নেওয়ার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে)।’
ফ্রান্সের বিপক্ষে ফাইনালটা টাইব্রেকারে গড়ানোর পর মেসির বিশ্বাস ছিল, আর্জেন্টিনা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছে। এমন আত্মবিশ্বাসের কারণ ছিল আর্জেন্টিনার হয়ে গোলপোস্টের নিচে এমিলিয়ানো মার্তিনেসের উপস্থিতি। এ প্রসঙ্গে মেসি বলেছেন, ‘আমরা জানি, ম্যাচ পেনাল্টিতে গেলে আমাদের একজন দানব আছে।’ টাইব্রেকারের আগে কোলো মুয়ানির শট ঠেকানো প্রসঙ্গে মার্তিনেসকে নিয়ে মেসির ভাষ্য, ‘ওরা যদি গোলটা করত, তাহলে ম্যাচটা হতো পাগলাটে। কিছু ক্ষেত্রে আপনাকে ভাগ্যকেও পাশে পেতে হয়। তবে ওটাতে (মুয়ানির শট ঠেকানো) ভাগ্যের ছোঁয়া ছিল না, ওটার পুরো কৃতিত্ব দিবুর (মার্তিনেসের)।’
২০২২ বিশ্বকাপের ফাইনালে অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সের পরও স্বপ্নভঙ্গ হওয়াকে নিজের ২০১৪ বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করেছেন মেসি। ব্রাজিলে আয়োজিত ওই বিশ্বকাপে ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরেছিল আর্জেন্টিনা। দুটো অভিজ্ঞতা তুলনা করে মেসি বলেছেন, ‘এমবাপ্পে ২০১৮ বিশ্বকাপ জিতেছে বলে মনে একটা প্রশান্তি পায়। (২০২২) ফাইনালে ও যা করেছে, এটা রীতিমতো ভয়ঙ্কর। সে চার গোল করেছে (টাইব্রেকারে শটসহ), এরপরও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। এমন কিছু আমার সঙ্গে ঘটেছে ২০১৪ বিশ্বকাপে। এটা আমার জন্য যন্ত্রণাদায়ক ছিল। পেছনে ফিরে তাকালে, আমিও দুটি বিশ্বকাপ জিততে পারতাম।’
তবে সেই আক্ষেপ নেই মেসির। ক্লাব ফুটবলে সম্ভাব্য সব জেতার পর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারও পূর্ণ মেসির। এজন্য সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেও ভোলেননি আর্জেন্টাইন অধিনায়ক, ‘ফুটবলে আমি সবকিছু জিতেছি- এমনটা বলতে পারা মোটেও সহজ কথা নয়। আমি সবসময়ই বলি, ঈশ্বর আমাকে যা কিছু দিয়েছেন, আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। ঈশ্বর আমাকে সবকিছু দিয়েছেন।’
মেসি আরও বলেছেন, ‘আমি এর চেয়ে বেশি কিছু চাইতে পারতাম না। আমার একটা বিশ্বকাপের অভাব ছিল। আমি সবকিছু জিতেছি। সবকিছু অর্জন করেছি।’
তা ২০২৬ বিশ্বকাপ খেলবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মেসি জানিয়েছেন, আগে এই বছরটা ভালোভাবে শেষ করতে চান। এরপর সিদ্ধান্ত নেবেন, তাঁর শরীর সায় দেয় কি না। মেসির ভাষায়, ‘২০২৬ বিশ্বকাপ নিয়ে আমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে এ বছরটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অবশ্যই আমি ২০২৬ বিশ্বকাপ এবং সেখানে খেলা নিয়ে ভাবছি। কিন্তু আমি প্রতিটি দিন ধরে এগোচ্ছি। আমি সেখানে (২০২৬ বিশ্বকাপে) খেলতে পারব কি না, এটা নিয়ে আমার নিজের সঙ্গে আমাকে সৎ থাকতে হবে।’