আর ৩ দিন পরেই মাঠে গড়াচ্ছে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ। ৩২ দল নিয়ে এই প্রথমবার ক্লাব বিশ্বকাপ আয়োজিত হতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে হতে যাওয়া টুর্নামেন্টটা ১৫ জুন শুরু হবে লিওনেল মেসির ক্লাব ইন্টার মায়ামির ম্যাচ দিয়ে।
নতুন ঢংয়ে হতে যাওয়া এই ক্লাব বিশ্বকাপকে ঘিরে আগ্রহের কমতি থাকতে পারে। এমনই যে, দর্শক টিকিট কিনছে না দেখে কদিন আগে টিকিটের দামই একেবারে কমিয়ে দিয়েছে ফিফা। তবে আগ্রহ যেমনই থাকুক, টুর্নামেন্টটা নিয়ে ফুটবলপ্রেমীদের প্রশ্নের যেন শেষ নেই। ৩২ দল কীভাবে নির্বাচিত হলো, রেয়াল মাদ্রিদ থাকলেও তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনা কেন নেই, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ থেকে ম্যানচেস্টার সিটি ও চেলসি থাকলেও এবার লিগ জেতা লিভারপুল না থাকার কারণ কী – প্রশ্ন অনেক।
বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে নামবে ১৯ জুন সৌদি আরবের ক্লাব আল হিলালের বিপক্ষে রেয়াল মাদ্রিদ। সবচেয়ে বেশি ইউরোপিয়ান শিরোপা জেতা ক্লাবটি এবারের ক্লাব বিশ্বকাপে তাঁদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনাকে পাচ্ছে না। কারণটা অনেকটা পরিষ্কার, ফিফা বিশ্বকাপের মূল পর্বের ড্র-তেই যেতে পারেনি লা লিগার বর্তমান চ্যাম্পিয়ন বার্সেলোনা। শুধু স্প্যানিশ জায়ান্টরা নয়, এই বিশ্বকাপে খেলতে পারবে না প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন লিভারপুল ও ইতালিয়ান সেরি-আ চ্যাম্পিয়ন নাপোলি।
ক্লাব বিশ্বকাপ বলে কথা, অথচ ইউরোপের তিন লিগের বর্তমান তিন চ্যাম্পিয়নই অংশ নিতে পারছে না। কী এমন কারণ যে ফিফা তিনটি বড় লিগের চ্যাম্পিয়ন দল ছাড়াই এই বিশ্বকাপ আয়োজন করতে যাচ্ছে?
ফিফা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখন থেকে বাড়তি কলেবরের এই ক্লাব বিশ্বকাপ হবে চার বছর পর পর। সেখানে দলগুলোর অংশগ্রহণের শর্ত হিসেবে আগের চার বছরের পারফরম্যান্সকে বিবেচনা করা হবে। সরলভাবে বললে, এখানে মূলত চারটি শর্ত –
১. আগের চার বছরে ফিফার ছয় কনফেডারেশনের ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বসূচক টুর্নামেন্টের শিরোপাজয়ী (ইউরোপে যেমন চ্যাম্পিয়নস লিগ, লাতিন আমেরিকায় কোপা লিবার্তাদোরেস…)।
২. এর বাইরে দল নির্ধারিত হবে আগের চার বছরে নিজ নিজ মহাদেশীয় টুর্নামেন্টে ক্লাবগুলোর পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে তৈরি করা সূচক দেখে।
৩. এর বাইরে স্বাগতিক দেশের দুটি ক্লাব পাবে অংশ নেওয়ার সুযোগ। যে কারণে এবার যুক্তরাষ্ট্রের এমএলএসের একটি ক্লাব মেসির মায়ামি। যদিও সেখানে বিতর্ক আছে। এমএলএসে সাধারণত জয়ী দল হিসেবে ভাবা হয় এমএলএস কাপ জেতা দলটিকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব ফুটবলের নিয়মটাই এমন যে, লিগ মৌসুমে দুই কনফারেন্স (ইস্টার্ন ও ওয়েস্টার্ন) মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট পাওয়া দলকে সাপোর্টার্স শিল্ড দেওয়া হয় – ইউরোপের দেশগুলোতে যা লিগ শিরোপার সমতুল্য।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে লিগের হিসেব-নিকেশ সেখানেই শেষ হয় না, নিয়মিত মৌসুমের পর দুই কনফারেন্সের সেরা ১৬ দল নিয়ে হয় নকআউট টুর্নামেন্ট এমএলএস কাপ। কিন্তু ফিফা অন্য দেশের লিগ শিরোপাজয়ীর সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নিয়ম রেখেছে, তাদের সাপোর্টার্স শিল্ড জেতা দলটাই সুযোগ পাবে ক্লাব বিশ্বকাপে। এবার সেটি মেসির মায়ামি জেতার পর (মায়ামি এমএলএস কাপে আগেভাগেই বাদ পড়েছে) ফিফার এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে মেসির মতো সুপারস্টারকে ক্লাব বিশ্বকাপে দেখার সুযোগের হিসেব-নিকেশ মেলাতে চাইলে মেলাতেই পারেন!
৪. এক দেশের দুটি ক্লাবের বেশি সুযোগ পাবে না। তবে যদি আগের চার বছরে এক দেশের দুটির বেশি ক্লাব মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বসূচক টুর্নামেন্ট জেতে তাহলে এই নিয়ম খাটবে না। ব্রাজিলের যেমন চারটি ক্লাব সুযোগ পাচ্ছে, কারণ আগের চার বছরের প্রতিটিতেই কোপা লিবার্তাদোরেসের শিরোপা জিতেছে ব্রাজিলের চারটি ভিন্ন ক্লাব।
এবার তাহলে কারা সুযোগ পেল?
আগের চার বছরের মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট জিতে এসেছে ১৬টি দল –
উয়েফা (চ্যাম্পিয়নস লিগ): চেলসি (২০২১), রেয়াল মাদ্রিদ (২০২২ ও ২০২৪) ও ম্যান সিটি (২০২৩)।
কনমেবল (কোপা লিবার্তাদোরেস): পালমেইরাস (২০২১), ফ্লামেঙ্গো (২০২২), ফ্লুমিনেন্স (২০২৩), বোতাফোগো (২০২৪)।
এএফসি (চ্যাম্পিয়নস লিগ): আল হিলাল (২০২১), উরাওয়া রেড ডায়মন্ডস (২০২২), আল আইন (২০২৩-২৪)।
কনক্যাকাফ (চ্যাম্পিয়নস লিগ): মন্তেরেই (২০২১), সিয়াটল সাউন্ডার্স (২০২২), পাচুকা (২০২৪) (২০২৩ সালের চ্যাম্পিয়ন লেওন বাদ পড়েছে তাদের মালিক গ্রুপো পাচুকা আবার মেক্সিকোর ক্লাব পাচুকারও মালিক হওয়ায়। পাচুকা বিশ্বকাপে আছে। একই মালিকানাধীন দুটি ক্লাব সুযোগ পাওয়ার নিয়ম নেই। লেওনের জায়গায় ২০২৩ সালের টুর্নামেন্টে রানার্সআপ লস অ্যাঞ্জেলেস এফসি সুযোগ পেয়েছে।)
আফ্রিকা (চ্যাম্পিয়নস লিগ): আল আহলি (২০২১, ২০২৩ ও ২০২৪), ওয়াইদাদ কাসাব্লাঙ্কা (২০২২)।
ওশেনিয়া (চ্যাম্পিয়নস লিগ): অকল্যান্ড সিটি (২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪)।
চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেনি, তবে ক্লাব সূচকে এগিয়ে থাকা ১৪ দল:
ইউরোপ: বায়ার্ন মিউনিখ, পারি সাঁ জার্মেই, বরুসিয়া ডর্টমুন্ড, ইন্তের মিলান, পোর্তো, আতলেতিকো মাদ্রিদ, বেনফিকা, ইউভেন্তুস, রেড বুল সালজবুর্গ।
কনমেবল: রিভার প্লেত, বোকা জুনিয়র্স।
এশিয়া: উলসান হুন্দাই।
আফ্রিকা: এসপেরান্স, মামেলোদি সানডাউনস।
ঠিক কোন কারণে বার্সেলোনা খেলতে পারছে না বিশ্বকাপে?
ফিফা আগেই জানিয়েছিল, এক দেশ থেকে ক্লাব বিশ্বকাপে মাত্র দুইটি দল অংশ নিতে পারবে এবং দল বাছাইয়ের ক্ষেত্রে চার বছরের পারফরম্যান্স দেখা হবে। চার বছরের মধ্যে একই দেশের দুইয়ের বেশি ক্লাব মহাদেশীয় চ্যাম্পিয়ন হলেই কেবল নিয়মের ব্যত্যয় হবে।
আগের চার বছরে চ্যাম্পিয়নস লিগ (তা-ও দুটি) রেয়াল মাদ্রিদ জেতায় স্পেন থেকে আর একটি ক্লাব সুযোগ পেত। সেক্ষেত্রে বিবেচ্য হয়ে ওঠে মহাদেশীয় টুর্নামেন্টে আগের চার বছরের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে তৈরি ক্লাব সূচক। বার্সেলোনা গত চার বছরে চ্যাম্পিয়নস লিগে মোটেও ভালো করতে পারেনি, দুবার তো গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়েছে। একবার খেলেছে শেষ ষোলোতে, আরেকবার কোয়ার্টার ফাইনালে। তাদের টপকে সূচকে এগিয়ে থাকায় স্পেনের দ্বিতীয় দল হিসেবে ক্লাব বিশ্বকাপে গেছে আতলেতিকো মাদ্রিদ।
ইংল্যান্ডে লিভারপুলের কপাল পুড়েছে আগের চার বছরে দুটি ইংলিশ ক্লাব (সিটি ও চেলসি) চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতায়। ফলে ইংল্যান্ড থেকে আর কোনো দল সুযোগ পায়নি। অথচ আগের চার বছরে চ্যাম্পিয়নস লিগের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে ক্লাব সূচকে লিভারপুল ওপরের দিকেই ছিল।