‘ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনাকে এই মানের ম্যাচ খেলতে হয় না। লাতিন আমেরিকায় ফুটবলটা ইউরোপের মতো এত ভালো নয়’ - কাতারে ২০২২ বিশ্বকাপের মাস সাতেক আগে কথাটা বলেছিলেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। সেই বিশ্বকাপের আগে চারবারেই ইউরোপিয়ান কোনো দলের বিশ্বজয়ের স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়ে এমবাপ্পে কথাটা বলেছিলেন কাতার বিশ্বকাপে কেন ইউরোপিয়ান দলগুলোই ফেবারিট, সেটা বোঝাতে।
কথাটার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি অনেক, তবে এমবাপ্পেকে একটা জবাব কাতার বিশ্বকাপেই দিয়েছে আর্জেন্টিনা। মেসির আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপটা নিয়ে গেল তো ধ্রুপদী ফাইনালে এমবাপ্পের ফ্রান্সকেই হারিয়ে, যদিও শেষ পর্যন্ত নিষ্পত্তিটা হয়েছে টাইব্রেকারে। ফাইনালের পর আর্জেন্টিনা স্ট্রাইকার লওতারো মার্তিনেসকে আবার এমবাপ্পের কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করা হলে মার্তিনেস বলেছিলেন, ‘ফুটবল নিয়ে ওর যথেষ্ট জ্ঞান নেই।’
জাতীয় দলগুলোর বিশ্বকাপের পর এবার নতুন ঢংয়ে ৩২ দলের ক্লাব বিশ্বকাপ যখন চলমান, সেখানে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার ক্লাবগুলোর পারফরম্যান্স দেখে মনে হবে, যেন এমবাপ্পেকে অনুচ্চারে জবাব দিয়ে চলেছে দুই দেশের ছয় ক্লাব।
ক্লাব বিশ্বকাপে শেষ পর্যন্ত ফেবারিট কে – প্রশ্নে ইউরোপের ক্লাবগুলোই এগিয়ে থাকবে। জাতীয় দলের তুলনায় বরং ক্লাব ফুটবলে ইউরোপ আরও এগিয়ে, তা টাকা-পয়সায় বলুন আর সাফল্যে বা দলীয় শক্তিতে। ক্লাব বিশ্বকাপেও এবার তাই রেয়াল মাদ্রিদ, পিএসজি, ম্যানচেস্টার সিটি, বায়ার্ন মিউনিখ, আতলেতিকো মাদ্রিদের মতো দলের বিপরীতে ব্রাজিলের বোতাফোগো, ফ্লামেঙ্গো বা আর্জেন্টিনার বোকা জুনিয়র্স, রিভার প্লেতের মতো ক্লাবকেও কেউ গোনায় ধরেনি। কাগজে-কলমের হিসাবে না ধরাটা হয়তো অযৌক্তিকও নয়।
তবে এখন পর্যন্ত গ্রুপ পর্বে বেশ কয়েকটি ম্যাচ পেরিয়ে যাওয়ার পর কাগজে-কলমের হিসেবনিকেশকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে বাধ্য করছে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার ক্লাবগুলো। গতকাল ইউরোপের চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ী পিএসজিকে হারিয়ে ব্রাজিলিয়ান লিগে এই মুহূর্তে আট নম্বরে থাকা বোতাফোগো সে অনুভূতিটা আরও জোরালই করেছে।
শুধু বোতাফোগোই কেন, বিশ্বকাপে যাওয়া ব্রাজিলের চার আর আর্জেন্টিনার দুই – মোট ছয় ক্লাবের পারফরম্যান্সই যে এখন পর্যন্ত ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ক্লাব ফুটবল নিয়ে নেতিবাচক মনোভাবকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।
গ্রুপ এ-তে মেসির ইন্টার মায়ামির গ্রুপের শীর্ষে ব্রাজিলের ক্লাব পালমেইরাস, এখন পর্যন্ত দুই ম্যাচ শেষে পালমেইরাস ও মায়ামির পয়েন্ট ৪। এমনই অবস্থা যে, ২০০৪ চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী ও পর্তুগালের প্রধান তিন ক্লাবের একটি পোর্তোর গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়াই প্রায় নিশ্চিত।
গ্রুপ বি-তে গতকাল বোতাফোগো ১-০ গোলে পিএসজিকে হারিয়ে সবার আক্কেলগুড়ুমের মতো অবস্থাই তৈরি করে দিয়েছে! যে গ্রুপে পিএসজি আর আতলেতিকো মাদ্রিদের মতো দল আছে, সে গ্রুপে দুটি করে ম্যাচ শেষে এখন কিনা বোতাফোগো সর্বোচ্চ ৬ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ শীর্ষে! এমনই অবস্থা যে, গ্রুপের শেষ ম্যাচে বোতাফোগোর বিপক্ষে নামতে যাওয়া আতলেতিকো মাদ্রিদ এখন প্রমাদ গুনছে। গ্রুপের অন্য দল সিয়াটল সাউন্ডার্সের বিপক্ষে পিএসজির জয় প্রত্যাশিত ধরে নিলে, আতলেতিকোকে পরের রাউন্ডে যেতে হলে নিজেদের শেষ ম্যাচে বোতাফোগোর বিপক্ষে অন্তত তিন গোলের ব্যবধানে জিততে হবে! এই মুহূর্তে পিএসজি আর আতলেতিকোর পয়েন্ট ৩।
গ্রুপ সি-তে আর্জেন্টিনার বোকা জুনিয়র্স আগামীকাল সকালে নামবে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে। তার আগে তারাও নিজেদের প্রথম ম্যাচে চমকে দিয়েছে। পর্তুগালের বেনফিকার সঙ্গে ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত ২-২ গোলে ড্র হলেও ২৭ মিনিটে ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল বোকাই! শেষ পর্যন্ত তিন লাল কার্ড দেখা ম্যাচটাতে বোকার স্প্যানিশ মিডফিল্ডার আন্দের এরেরা প্রথমার্ধের শেষদিকে ম্যাচের প্রথম লাল কার্ড দেখে দলকে দশজনের বানিয়ে না দিলে বেনফিকার পক্ষে ফিরে আসা সম্ভব হতো কি না, এ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। বেনফিকার গোল দুটি আবার দুই আর্জেন্টাইনের - প্রথমার্ধে এরেরা লাল কার্ড দেখার পর যোগ করা সময়ে একটি গোল করেছেন আনহেল দি মারিয়া, দ্বিতীয়ার্ধে ৭২ মিনিটে বেনফিকার আন্দ্রেয়া বেলোত্তি আর ৮৮ মিনিটে বোকার হোর্হে ফিগালের লাল কার্ড দেখার ফাঁকে ৮৪ মিনিটে বেনফিকাকে সমতায় ফেরান নিকোলাস ওতামেন্দি।
গ্রুপ ডি-তে একটি করে ম্যাচ শেষে চেলসির সমান ৩ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ শীর্ষে ফ্লামেঙ্গো। গ্রুপ ই-তে আর্জেন্টিনার রিভার প্লেত ১ ম্যাচে ৩ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ শীর্ষে, অথচ এই গ্রুপেই আছে এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে রানার্স ইন্তের মিলানো। আগের ম্যাচে মেক্সিকোতে সের্হিও রামোসের ক্লাব মন্তেরেইয়ের সঙ্গে ড্র করে ইন্তের আছে পয়েন্ট তালিকার তিন নম্বরে।
গ্রুপ ই-তে ব্রাজিলের আরেক ক্লাব ফ্লুমিনেন্স জয় পায়নি, তবে যা করেছে, তাতে মুগ্ধ না হয়ে উপায় আছে! ধারে-ভারে-নামে অনেক এগিয়ে থাকা জার্মান ক্লাব বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচে গোলশূন্য ড্র করেছে ফ্লুমিনেন্স, যে ম্যাচে ডর্টমুন্ডের এক পয়েন্ট পাওয়াকেও বলতে হয় ভাগ্যপ্রসূত।
টুর্নামেন্টের মাত্রই শুরু বলে এখনই রায় দেওয়ার সময় আসেনি, তবে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার ক্লাবগুলো এরই মধ্যে ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলোকেও নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছে। সব ক্লাব তো আর পারার সম্ভাবনা কম, তবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ছয় ক্লাবের সিংহভাগ নকআউট পর্যন্ত এভাবে খেলে যেতে পারলেই হলো, এমবাপ্পের মন্তব্যটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবার ভাইরাল হতে সম্ভবত দেরি হবে না!