বার্সেলোনাতে নিকো উইলিয়ামস আসছেন - তা এক প্রকার নিশ্চিত ভেবেছিলেন ক্লাবটার সমর্থকরা। না ভাবার কোনো কারণও তো ছিল না! কদিন ধরে কাতলান ক্লাবের ম্যানেজমেন্ট ও বার্সেলোনার স্প্যানিশ সতীর্থদের সঙ্গে নিকো উইলিয়ামসের সখ্যতা অন্তত তেমন ধারণাই দিচ্ছিল। স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যমেও নিকোর বার্সায় যোগ দেওয়া সময়ের ব্যাপার বলে জানানো হচ্ছিল। অবস্থা এমন, যেন গাছে কাঁঠাল রেখে গোঁফে তেল দিতে শুরু করেছিলেন বার্সা সমর্থকেরা!
কিন্তু কাঁঠাল আর হাতেই পাওয়া হচ্ছে না তাঁদের। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০৩৫ পর্যন্ত আথলেতিক বিলবাওয়ের সঙ্গে চুক্তি করে ফেলেছেন নিকো উইলিয়ামস। আজ এক বিবৃতিতে বিলবাও জানিয়েছে, ২০৩৫ সালে পর্যন্ত ক্লাবটিতে থাকবেন ২২ বছর বয়সী স্প্যানিশ উইঙ্গার। তাঁর সঙ্গে বিলবাওয়ের আগের চুক্তির মেয়াদই ছিল ২০২৭ পর্যন্ত, সেটির মেয়াদ আরও ৮ বছর বাড়িয়ে চুক্তি নবায়ন করেছে বিলবাও। নিকোর বেতন দ্বিগুণ হয়েছে বলে জানাচ্ছে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম, পাশাপাশি তাঁর রিলিজ ক্লজের অঙ্কটা ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে বলে জানাচ্ছে তারা। আগের চুক্তিতে নিকোর রিলিজ ক্লজ ছিল ৬ কোটি ইউরোর আশেপাশে।
এ যেন এক নাটকীয় ট্রান্সফারের সমাপ্তি, যা বার্সেলোনার কাছে এক ধাক্কা। এক মাস ধরেই এই উইঙ্গারকে পেতে সরব ছিল কাতালান ক্লাবটি। স্প্যানিশ ও ইউরোপিয়ান অনেক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছিল, নিকোর রিলিজ ক্লজের (আগের চুক্তি) ৬ কোটি ইউরো পরিশোধ করে তাঁকে দলে নিয়ে যেতে বার্সা খেলোয়াড়ের সঙ্গে আলোচনাও সেরে ফেলেছিল। স্পেন জাতীয় দলে খেলার সুবাদেই বার্সা উইঙ্গার লামিন ইয়ামালের সাথে বন্ধুত্ব নিকোর, ইয়ামালের ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে গত কিছুদিনে নিকোর সঙ্গে ছবি শেয়ার করা বোঝাচ্ছিল, বার্সা নিকোকে নেওয়ার কাজে এগিয়ে গেছে অনেকটা।
বার্সার স্পোর্টিং ডিরেক্টর দেকোও সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘নিকোর বার্সায় খেলার আগ্রহ আছে।’ নিকোর এজেন্ট ফেলিক্স তাইন্তার সঙ্গেও ব্যক্তিগত শর্তাবলি নিয়ে আলোচনা এগিয়ে রেখেছিল বার্সেলোনা।
বার্সেলোনার এমন তৎপরতা দেখে বিলবাও পর্যন্ত স্প্যানিশ লা লিগার কাছে অভিযোগ করে। বার্সার আর্থিক দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে তারা অভিযোগ করে, বার্সা কীভাবে এই অবস্থায়ও নিকোর মতো একজন তারকাকে নেওয়ার চেষ্টা করে! পাশাপাশি বার্সাকে হুঁশিয়ার করে দেয়, নিকোকে রিলিজ ক্লজ দিয়ে বিলবাও থেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলে বার্সাকে পুরো ৬ কোটি ইউরো একবারে পরিশোধ করতে হবে!
শুধু বিলবাও ক্লাবই নয়, নিকো বিলবাওকে কাঁচকলা দেখিয়ে বার্সায় চলে যাচ্ছেন ধরে নিয়ে বিলবাও সমর্থকেরাও নিকোর ম্যুরালের ছবি বিকৃত করে। তা-ও এক দফায় নয়। একবার বিকৃত করার পর বিলবাও ম্যুরালটা ঠিকঠাক করেছিল, সমর্থকেরা আবার সেটি বিকৃত করেন!
এমনকি গতকাল রাতেও বার্সার খবরাখবর জানানোর ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত সাংবাদিকদের বেশিরভাগই জানিয়েছিলেন, নিকো বার্সায় আসছেন, এটা নিশ্চিত। কিন্তু আজ নিকো যে বিলবাওয়ের সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করেছেন, সেটাও নাকি বার্সা কর্তৃপক্ষ জানতে পেরেছে বিলবাওয়ের নিকোর সঙ্গে চুক্তি নবায়নের টুইট দেখে!
তা ঠিক কোন জায়গায় নিকো-বার্সার প্রায় হতে যাওয়া দলবদল শেষ পর্যন্ত ইউটার্ন নিয়েছে?
স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম ও ইউরোপের খেলাধুলার ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যম দ্য অ্যাথলেটিক জানাচ্ছে, ঝামেলাটা বেঁধেছে বার্সা নিকোকে দলে টানলেও শেষ পর্যন্ত নিবন্ধন করাতে পারবে কি না, সে নিয়ে সংশয়ের কারণে। বার্সার হাতে টাকা আছে, কিন্তু আর্থিক বিবরণীতে তাদের এমনই বাজে অবস্থা যে, লিগের বেঁধে দেওয়া আয়-ব্যয়ের সীমা মেনে দলবদলে কয়েক মৌসুম ধরেই তারা খাবি খাচ্ছে। এই মৌসুমেও নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী এসপানিওল থেকে গোলকিপার হোয়ান গার্সিয়াকে রিলিজ ক্লজের টাকা পরিশোধ করে দলে নিয়েছে বটে বার্সা, কিন্তু তাঁর নিবন্ধন এখনো হয়নি। গত মৌসুমে দানি অলমোর নিবন্ধন নিয়েও কত জলঘোলাই না হলো!
দ্য অ্যাথলেটিক জানাচ্ছে, বার্সার আর্থিক বিবরণীর এমন অবস্থার কারণে নিকোর এজেন্ট শর্ত রেখেছিলেন, নিকোকে দলে টানার চুক্তিতে বার্সা যাতে একটা ‘ক্লজ’ রাখে, যেখানে বার্সা শেষ পর্যন্ত নিকোর নিবন্ধন করাতে না পারলে নিকোকে বিনামূল্যে ক্লাব ছাড়তে দেওয়ার সুযোগ রাখা হবে। বার্সা কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিকভাবেই তাতে রাজি হয়নি।
স্প্যানিশ সাংবাদিক ফের্নান্দো পোলো গতকাল জানিয়েছেন, বার্সা শেষ পর্যন্ত পাল্টা শর্ত হিসেবে দিয়েছে এটি যে, তারা নিকোকে নিবন্ধন করাতে না পারলে তারা যত খরচ করবে নিকোর জন্য, সে অঙ্ক পরিশোধ করে কোনো ক্লাব চাইলে নিকোকে নিতে পারবে। এমন শর্ত ট্রান্সফার উইন্ডো চালু থাকাকালীন সময়ে চুক্তির ধারা হিসেবে যোগ করা যাবে বলে বার্সা জানিয়েছে নিকোর এজেন্টকে।
কিন্তু সাদা চোখে সেটা কাগজে-কলমে প্রায় অসম্ভব। কারণ, বার্সা রিলিজ ক্লজ দিয়ে নিকোকে বিলবাওয়ের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া মানে নিকো আর বিলবাওয়ের নিবন্ধিত খেলোয়াড় নন, আবার বার্সাও এরপর তাঁর নিবন্ধন করাতে না পারলে তখন নিকো বার্সারও খেলোয়াড় কাগজে-কলমে থাকবেন না। সে ক্ষেত্রে কোন চুক্তির বিপরীতে কোনো ক্লাব বার্সাকে টাকা পরিশোধ করবে নিকোর জন্য, সে নিয়ে ধোঁয়াশা তো থেকেই যায়!
এতসব ধোঁয়াশার মধ্যেও গতকাল পর্যন্ত বার্সা ও বিলবাওভিত্তিক সাংবাদিকদের দিক থেকে জানা গিয়েছিল, বার্সা ও নিকোর এজেন্ট এক সপ্তাহ সময় নিয়েছেন। এর মধ্যে আজ তাই নিকোর বিলবাওয়ে চুক্তি নবায়ন বার্সার জন্য বড় ধাক্কাই হয়ে এসেছে। অবশ্য বার্সার দিকের কয়েকজন সাংবাদিক আগেও জানিয়েছেন যে, নিকোকে দলে নেওয়া নিয়ে বার্সার কর্তাব্যক্তিদের কয়েকজন পুরোপুরি সম্মত নন। ক্রীড়া পরিচালক দেকোই নাকি নিকোর চেয়ে লিভারপুলের উইঙ্গার লুইস দিয়াসকে নিতে বেশি আগ্রহী।ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে ধারে মার্কাস রাশফোর্ড কিংবা এসি মিলানের পর্তুগিজ উইঙ্গার রাফায়েল লেয়াওয়ের প্রতিও আগ্রহী বার্সা।
কদিন আগে নিকো উইলিয়ামস নিজ থেকেই বার্সায় যেতে চান জানানো হলেও আজ বিলবাওয়ে চুক্তি নবায়নের পর আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে অবশ্য তিনি খুশি বলেই জানিয়েছেন। অবশ্য আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে তো তা-ই বলার কথা! যোগ দিতে পেরে অনেক খুশি। নতুন চুক্তির পর উইলিয়ামস বিলবাওয়ের এক ভিডিওবার্তায় বলেছেন, ‘সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো হৃদয়ের কথা শোনা। আমি যেখানে থাকতে চাই, সেখানেই আমার কাছের মানুষদের সঙ্গে আছি। এটাই আমার বাড়ি।’
বিলবাও চুক্তি নবায়নের ঘোষণা দেওয়া টুইটে যে ভিডিও সংযুক্ত করেছে সেটিও তাৎপর্যপূর্ণ। বিলবাওয়েই খেলেন নিকোর ভাই ইনাকি উইলিয়ামসও, দুজনের একটা ম্যুরাল আছে বিলবাওয়ে। ভিডিওতে সেই ম্যুরালের গায়ে নিকো লিখে দেন – ২০৩৫। সমর্থকেরা তাঁর ক্লাব ছাড়ার গুঞ্জনে বিরক্ত হয়ে ম্যুরাল বিকৃত করেছিলেন, নিকো সেই ম্যুরালই ‘বিকৃত’ করলেন তাঁর চুক্তি নবায়নের ঘোষণায়!