বিশ্বজুড়ে পুত্রের তুলনায় কন্যাসন্তানের প্রাধান্য বাড়ছে। অনেক বাবা-মা এখন কন্যাসন্তান নিতে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। সম্প্রতি ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
একটা দীর্ঘ সময় বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ছেলে সন্তানের প্রতি প্রবল পক্ষপাত ছিল। এখনো অনেক সংস্কৃতিতে পরিবার ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারে ছেলের অগ্রাধিকার বেশি। জনসংখ্যায় বৃহৎ দুই দেশ চীন ও ভারতে এক সময় আলট্রাসাউন্ড প্রযুক্তির সাহায্যে গর্ভে থাকা সন্তানের লিঙ্গ জেনে বিপুলসংখ্যক কন্যাভ্রূণ গর্ভপাত করা হতো। ফলে এসব দেশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ছেলের সংখ্যা মেয়ের তুলনায় ছিল অনেক বেশি।
তবে এখন সে চিত্র বদলাচ্ছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঐতিহ্যগতভাবে ছেলে সন্তানের প্রতি প্রবল আকাঙ্ক্ষা থাকা পরিবারগুলোর মনোভাব এখন দ্রুত বদলাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ছেলের প্রতি সেই পক্ষপাত অনেকটাই কমে এসেছে। আর উন্নত দেশগুলোতে মেয়েদের প্রতি পক্ষপাত বাড়ছে।
১৯৮০ সাল থেকে ছেলের তুলনায় প্রায় ৫ কোটি মেয়ে কম জন্মেছে। শুধু ২০০০ সালেই ১৭ লাখ বেশি ছেলে জন্মেছে। ২০১৫ সালেও এই সংখ্যাটা ছিল ১০ লাখের বেশি। তবে ২০২৫ সালে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়াচ্ছে মাত্র ২ লাখে। ছেলে সন্তানের প্রতি বৈশ্বিক পক্ষপাত বলতে গেলে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
১৯৯০ সাল থেকে আনুমানিক ২ কোটির বেশি কন্যাভ্রূণ গর্ভপাত করা হয়েছে। তবে ২০২৫ সালের পূর্বাভাস বলছে, বিশ্বে কন্যাভ্রূণ গর্ভপাতের সংখ্যাটি নেমে আসবে মাত্র ১ লাখ ৭ হাজারে, যা ২০০০ সালের তুলনায় সাতগুণ কম। ২০০০ সালে বিশ্বে ৮ লাখ ৬ হাজার কন্যাভ্রূণ গর্ভপাতের শিকার হয়।
এই বদলের অন্যতম উদাহরণ, দক্ষিণ কোরিয়া। ১৯৯০– এর দশকে প্রতি ১০০ মেয়ে সন্তানের বিপরীতে ১১৭টি ছেলে জন্মালেও বর্তমানে এই হার ১০৫: ১০০। দেশটিতে বর্তমানে ১০৫ জন কন্যার বিপরীতে ১০০ ছেলের জন্ম হচ্ছে। চীন ও ভারতে এখনো যথাক্রমে প্রতি ১০০ কন্যার বিপরীতে ১১১ এবং ১০৭ জন পুত্র জন্ম নিচ্ছে।
সন্তানের প্রতি এ প্রাধ্যান্যে পশ্চিমা দেশগুলোতে বাবা–মায়ের মনোভাবের পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য। এ বিষয়ে ২০২৩ সালে ‘ডেমোগ্রাফিক রিসার্চ’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়– বেলজিয়াম, জার্মানি, ফ্রান্সসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে প্রথম সন্তান মেয়ে হলে দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার প্রবণতা কম।
সন্তান নেওয়ার অগ্রাধিকারে বাংলাদেশে এক ধরনের ভারসাম্য দেখা যায়। এখানে মেয়ে সন্তান থাকলে ছেলে সন্তান নেওয়ার প্রবণতা বেশি, আবার ছেলে সন্তান থাকলে মেয়ে সন্তানের প্রতি আগ্রহ বাড়ে বাবা–মায়ের। সাব-সাহারান আফ্রিকার অনেক অংশেও পরিবারে ছেলে-মেয়ে সংখ্যার ভারসাম্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
সম্প্রতি জাপানে একটি জরিপে দেখা গেছে, এক সন্তান নিতে ইচ্ছুক দম্পতিদের ৭৫ শতাংশই কন্যাসন্তানকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। অথচ দেশটিতে আশির দশকে এই হার ছিল ৫০ শতাংশের নিচে।
যুক্তরাষ্ট্রে কন্যাসন্তানের প্রতি আগ্রহ এতটাই বেড়েছে যে, আইভিএফ-এর মাধ্যমে সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে কন্যাভ্রূণ বেছে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এমনকি দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রেও বিষয়টি লক্ষণীয়। ২০১০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে সন্তান দত্তকে অভিভাবকেরা মেয়ে সন্তানের জন্য ১৬ হাজার ডলার পর্যন্ত দিতে রাজি। দক্ষিণ কোরিয়ায়ও দত্তক নেওয়া শিশুর মধ্যে বেশির ভাগই মেয়ে।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতে, কন্যাসন্তানকে অনেকেই যত্নশীল মনে করেন। এ ছাড়া সহজে বড় করা যায়, এমন ধারণা থেকে বেশি পছন্দ করছেন বলা যায়। ছোটবেলা থেকেই মেয়েরা ‘তুলনামূলকভাবে ভালো’ এমন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হচ্ছে। এমনকি পড়াশোনা বা বিভিন্ন দক্ষতায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা সফলতায় এগিয়ে। বিশেষ করে ধৈর্য্য ও সময় নিয়ে সঙ্গীত বা শিল্পের মতো প্রশিক্ষণে পিছিয়ে পড়ছে ছেলেরা।
ধনী দেশগুলোতে ছেলেরা স্কুলে মেয়েদের তুলনায় খারাপ ফল করে, সহিংসতার শিকার হয় বেশি, বিশ্ববিদ্যালয়ে কম যায়, এমনকি আত্মহত্যার ঝুঁকিও বেশি। আমেরিকায় বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা অনেক বেশি। আমেরিকান সমাজে বাবা-মায়ের অবস্থান বিবেচনায় দেখা যায়– সেখানে মেয়েরা এগিয়ে।
চীনে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের সংখ্যা এত বেশি যে বিয়ের জন্য কনে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যুক্তরাজ্যে ছেলেদের মধ্যে বেকারত্ব ও পড়াশোনা শেষ না করার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে অনেক পরিবার এখন মেয়ে সন্তানকে ‘নিশ্চিন্ত’ হিসেবে দেখছে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, হেটারোসেক্সুয়াল পুরুষেরা মনে করেন মেয়েদের ‘সহজে বড় করা যায়’, ‘বেশি বুদ্ধিমান’ ও ‘আকর্ষণীয় চরিত্রের’ হয় এবং ছেলে সন্তানদের মতো ‘বিপজ্জনক’ নয় মেয়েরা। অনেক অভিভাবক মনে করেন, মেয়েরা বড় হলে বাবা-মায়ের যত্ন নেবে, আর ছেলেরা দূরে সরে যাবে। ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেনের মতো সমতার দেশেও দম্পতিরা ছেলের তুলনায় অন্তত একটি মেয়ে চায় বেশি। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দেখভালের ক্ষেত্রে মেয়েরাই এগিয়ে থাকে বলে অনেকের ধারণা।
দীর্ঘমেয়াদে এই পরিবর্তন সমাজে ভারসাম্য ফেরাতে সহায়তা করবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ছেলের অগ্রাধিকারের কারণে যেসব সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়– যেমন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, বাল্যবিবাহ ও মেয়ে শিশু পাচারের মতো উদ্বেগজনক বিষয় কিছুটা হলেও কমবে। তবে এর প্রভাব পুরোপুরি দূর হতে কয়েক দশক লাগবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
যদিও এখনো বিশ্বজুড়ে সন্তান জন্মের অনুপাতে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়নি, তবে এই পক্ষপাত গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে যেমন কন্যাভ্রূণ হত্যা সমাজে গভীর বৈষম্যের ইঙ্গিত দেয়, তেমনই ধনী দেশে মেয়ে সন্তানের প্রতি পক্ষপাতও সমাজ কাঠামোর এক নতুন পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, দ্য টাইমস