পারভেজ মোশাররফ: দিল্লি থেকে ইসলামাবাদের চূড়ায়

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ছিলেন পারভেজ মোশাররফ। ফোর স্টার জেনারেল থেকে থেকে প্রতাপশালী সেনাশাসক। সেনাপ্রধান হওয়ার এক বছরের মাথায় ১৯৯৯ সালে এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেন পারভেজ মোশাররফ। যিনি একাধারে প্রায় একদশক শাসন করেছিলেন পাকিস্তানকে।

ক্ষমতা দখলের পর থেকে পাকিস্তানের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিকভাবে উদার মূল্যবোধের সূচনা করার চেষ্টা করেন তিনি।
দেশটির গণমাধ্যম জানায়, স্বেচ্ছায় নির্বাসনে থাকা সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার মারা গেছেন পারভেজ মোশাররফ। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন।

তিনি বহু বছর ধরে সেনাবাহিনীর ভেতর এবং বাইরে থেকে শক্তিশালী সমর্থন পেয়েছিলেন। তবে তার সবচেয়ে বড় হুমকি ছিল আল কায়েদা এবং আফগানিস্তানের তালেবান। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তাকে অন্তত তিনবার হত্যা করার চেষ্টা করেছিল এই জঙ্গি সংগঠনগুলো। কিন্তু সামরিক বাহিনীর ব্যাপক ব্যবহার এবং সেই সাথে আল কায়েদা ও আফগান তালেবানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চালানো যুদ্ধকে অব্যাহত সমর্থন দিয়েছিলেন তিনি। আর এসব কারণেই শেষ পর্যন্ত তার পতন আর ঠেকানো যায়নি।


১৯৪৩ সালের ১১ আগস্ট ব্রিটিশ ভারতের দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন পারভেজ মোশাররফ। দেশভাগের পর মাত্র চার বছর পর তার পরিবারে সঙ্গে পাকিস্তানের করাচিতে চলে আসেন। তার বাবা তৎকালিন নতুন সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি করতেন। মা ছিলেন শিক্ষিকা। উদার মুসলিম পরিবারে বেড়ে ওঠেন তিনি।

১৯৬১ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে কাকুলের পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে তিনি কমিশন পান। সেনাপ্রধান হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এলিট কমান্ডো বাহিনীর প্রধান ছিলেন।

১৯৯৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের কাছ থেকে রক্তপাতশূন্য অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেন মোশাররফ। ক্ষমতা দখলের পর থেকে পাকিস্তানের সংস্কারের জন্য তার নেওয়া কিছু পদক্ষেপ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়। যার মধ্যে নারী অধিকার রক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন। প্রথমবারের মতো বেসরকারি সংবাদ চ্যানেলের অনুমতি দিয়েছিলেন তিনি।

পাকিস্তানে জঙ্গিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে একনিষ্ঠতার সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। ২০০১ সালের ৯/১১ এর পর দেশীয় বিরোধতা সত্ত্বেও তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে সমর্থন করেন। আর উদারপন্থী মুসলিম হওয়ায় পশ্চিমা বিশ্বের কাছে তার কদর বাড়তে থাকে।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওই হামলার পর ওয়াশিংটনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু রাষ্ট্র হয় পাকিস্তান। এমনকি মার্কিন বাহিনীকে পাকিস্তানের মাটি ব্যবহার করে গোপন ঘাঁটি থেকে সশস্ত্র ড্রোন চালানোর অনুমতি দিয়েছিলেন তিনি। ওই সময় মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান এলাকায় হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আফগানিস্তান সীমান্তে দেশটির ভূমিহীন উপজাতি এলাকায় অভিযান চালাতে দেশীয় সেনাদের আদেশও দেন।

মোশাররফ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীতে অর্থ ঢালার জন্য লবিং করেছিলেন। তবুও, সেনাবাহিনীর আনুগত্য কখনই দ্ব্যর্থহীন ছিল না।

এদিকে মোশাররফ পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছিলেন।

২০০৮ সালে নির্বাচনে পরাজিত হন এবং ছয় মাস পর দেশ ত্যাগ করেন তিনি। ২০১৩ সালে দেশে ফিরে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়। তার অনুপস্থিতিতে সেই মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন দেশটির আদালত। পরে সেই আদেশ বাতিল করা হয়।

উন্নত চিকিৎসার জন্য ২০১৬ সালের মার্চে দেশ ছাড়েন পারভেজ মোশাররফ। সংযুক্ত আরব আমিরাত চলে যান তিনি। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। তারপর তিনি আর দেশে ফেরেননি।

/কা.বি./