চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এশিয়ার তিন দেশে পাঁচ দিনের রাষ্ট্রীয় সফর করছেন। গত সোমবার ভিয়েতমনাম সফরে গেছেন তিনি। অনেকগুলো বিনিযোগ চুক্তি সইয়ের পাশাপাশি রাজধানী হ্যানয়ে দেশটির শীর্ষ নেতা টু ল্যামের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে শি ল্যামকে বলেছেন, ‘আমাদের মিলেমিশে আমেরিকান একতরফা উপদ্রব মোকাবিলা করতে হবে।’
শি-ল্যামের বৈঠক নিয়ে সোমবারই মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমেরিকাকে আঘাত করতেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তিনটি দেশে রাষ্ট্রীয় সফরে করছেন বলে মনে করেন ট্রাম্প। ওভাল অফিসে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি চীনকে দোষ দিই না। ভিয়েতনামকেও দোষ দিই না। তাদের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। কীভাবে আমেরিকাকে ফাঁকি দেওয়া যায়, তাঁরা সেই উপায় খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছেন। তবে আপনারা ভুলে যাবেন না, এই উদ্দেশ্যেই কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গঠিত হয়েছিল।’
গত ২ এপ্রিল ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেন থেকে যে উচ্চ শুল্ক ঘোষণা করেছিলেন, তার অন্যতম ভুক্তভোগী ভিয়েতনাম। দেশটির ওপর আরোপ করা হয়েছে ৪৬ শতাংশ শুল্ক। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ট্রাম্পের ২ এপ্রিল ঘোষিত পাল্টা শুল্ক চীন ছাড়া বাকি দেশগুলোর ওপর ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। যদিও সার্বজনীন ১০ শতাংশ শুল্ক ঘোষণার দিন রাত থেকে কার্যকর হয়েছে। অবশ্য পরে চীনসহ সব দেশ থেকে আমেরিকায় আমদানি করা আইফোন, কম্পিউটারসহ যাবতীয় ইলেকট্রনিক্স পণ্যের শুল্কও কার্যকর হবে না বলে জানিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।
ইকোনমিস্টের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, শি যে ভিয়েতনাম গেলেন, এই সফর হুট করে ঠিক করা হয়নি। ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার বেশ আগেই শি’র দক্ষিণ‑পূর্ব এশিয়ার তিনটি দেশের সফরসূচি চূড়ান্ত করা হয়। ভিয়েতনাম দিয়ে তাঁর সফর শুরু হলো। ভিয়েতনাম থেকে তিনি যাবেন মালয়েশিয়াতে। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার কম্বোডিয়া যাবেন। শুক্রবার এ সফরের মধ্য দিয়ে সফর শেষ হবে।
ভিয়েতনামের মতো কম্বোডিয়ার ওপরও ৪৬ শতাংশ শুল্ক ঘোষণা করেছেন ট্রাম্প। মালয়েশিয়ার পণ্যের ওপর ঘোষণা করা হয়েছে ২৪ শতাংশ শুল্ক। এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশ থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের ওপর ঘোষণা করা হয়েছে যথাক্রমে ৩৬, ৩২ ও ১৭ শতাংশ শুল্ক।
এমন পরিস্থিতিতে আগে থেকে নির্ধারিত হলেও চীনা প্রেসিডেন্টের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তিন দেশে সফরকে বেশ সময়োপযোগী বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। কারণ, এই সফরের মধ্য দিয়ে শি অঞ্চলটির দেশগুলোর কাছে এই বার্তা দিতে পারবেন যে, চীন তাদের পাশে আছে।
চীনের সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া জানায়, সোমবার টু ল্যামের সঙ্গে বৈঠকে শি বলেছেন, ‘চীনের বাজার ভিয়েতনামের জন্য সব সময় খোলা। চীন ও ভিয়েতনামের কৌশলগত লক্ষ্যগুলো শক্তিশালী করা এবং যৌথভাবে আমেরিকার একতরফা উপদ্রবের বিরোধিতা করা উচিত।’
শি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থা এবং শিল্প ও সরবরাহ (চেইন) স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য দুই দেশের একসঙ্গে কাজ করা উচিত।’
বিশ্লেষকদের মতে, গত কয়েক বছরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো চীনের দিকে ঝুঁকেছে। এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে চীনের বাণিজ্য বাড়ার পাশাপাশি সেখানে চীনের বিনিয়োগও বেড়েছে। কিন্তু তার মানে এই না যে, তারা চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়। ভিয়েতনামের সঙ্গে ব্যবসায় চীনের উদ্ধৃত্ত অনেক বেশি। প্রতিবেশী কমিউনিস্ট দেশটি প্রতি অর্থবছরে যে অর্থমূল্যের পণ্য চীনে রপ্তানি করে, তার চেয়ে ১ দশমিক ৬ গুণ বেশি পণ্য চীন থেকে আমদানি করে। এখন চীনের পণ্যে যুক্তরাষ্ট্র ১৪৫ শতাংশ শুল্ক দেওয়ায় ভিয়েতনামসহ অঞ্চলটির অন্যান্য দেশের বাজার চীনের সস্তা পণ্যে সয়লাব হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ যেসব দেশের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করে তা ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে, তারা ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে বিশেষ ধরনের হুমকিতে আছে। ওয়াশিংটনের প্রত্যাশা, শুল্ক স্থগিত করা হয়েছে দর-কষাকষি করার জন্য, অন্য দেশের সঙ্গে যোগসাজশ করার জন্য নয়। যারা এমনটি করবে, তাদের শাস্তি পেতে হবে।
শি-ল্যাম বৈঠকের পর ট্রাম্প যে মন্তব্য করেছেন, তাতে প্রচ্ছন্ন সেই হুমকি রয়েছে। ট্রাম্পের এই হুমকি বা চীনের মতো বড় প্রতিবেশী অর্থনীতির সঙ্গে যে সাবধানে লেনদেন করতে হবে, সেই জ্ঞান এই অঞ্চলের নেতাদের রয়েছে।
ল্যামের আচরণ থেকেও বিষয়টি অনুমেয়। শুল্ক ঘোষণার পর শুরুর দিকে যারা ট্রাম্পকে ফোন করেছেন, ল্যাম তাদের একজন। তিনি ট্রাম্পকে প্রস্তাব করেছেন, ভিয়েতনাম আমেরিকার পণ্য থেকে সব শুল্ক প্রত্যাহার করবে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশটিতে প্রবেশ করতে কোনো শুল্ক লাগবে না। তিনি এরই মধ্যে ওয়াশিংটনে এক বিশেষ আলোচকও পাঠিয়েছেন।
কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রীও ট্রাম্পকে ফোন করে মার্কিন পণ্যে শুল্ক কমানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। মালয়েশিয়া সরবরাহ শৃঙ্খল এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের বিষয়ে একটি চুক্তি করার জন্য ওয়াশিংটনে একটি প্রতিনিধি দল পাঠাচ্ছে বলেও জানা গেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এসব আচরণকে বুদ্ধিদীপ্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে।
তথ্যসূত্র: ইকোনমিস্ট, সিএনএন, সিনহুয়া