১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পেছনে বিভিন্ন কারণ ছিল। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, যা নিয়ে পর্যাপ্ত অনুসন্ধান করা হয়নি। বিষয়টি হলো, ১৯৮০-র দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রমবর্ধমান অপ্রাসঙ্গিকতা। এই অপ্রাসঙ্গিকতা বিশেষভাবে প্রকট ছিল কয়েকটি ক্ষেত্রে: এক. আন্তর্জাতিক অর্থনীতি–যেখানে সোভিয়েত রুবল একটি রূপান্তরযোগ্য মুদ্রা ছিল না। দুই. আন্তর্জাতিক কূটনীতি–যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন মধ্যপ্রাচ্য বা গ্লোবাল সাউথে কোনো প্রধান ভূমিকা পালন করেনি। তিন. আন্তর্জাতিক আদর্শ–যেখানে সোভিয়েত মডেলটি কোনো প্রভাব ফেলেনি।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এডোয়ার্ড শেভারনাৎজে বুঝতে পেরেছিলেন যে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম প্রধান কাজ ছিল এই সমস্ত ক্ষেত্রে সোভিয়েত প্রাসঙ্গিকতা পুনরুদ্ধার করা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাঁদের সোভিয়েত নেতৃত্বের গোঁড়া অংশটির সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়েছিল। তাঁরা চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁরা কখনোই তাঁদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি।
ভিডিও দেখুন:
আমাদেরও নিজস্ব কট্টপন্থীরা আছে। যদিও আমেরিকা বিলুপ্তির হুমকির মুখে নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাহী পদক্ষেপগুলো স্পষ্টভাবে আমেরিকার আন্তর্জাতিক অবস্থানকে দুর্বল করছে এবং এর রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, এমনকি অর্থনৈতিক অবস্থানের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। জোর দিয়ে বলা যায় যে, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে আমেরিকার ভূমিকা ইতিমধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও নিরস্ত্রীকরণের কূটনীতিতে আমেরিকা আর কোনো বড় প্রভাবক নয়। প্রকৃতপক্ষে, জাতীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা (তথাকথিত গোল্ডেন ডোম)-এর ওপর আমেরিকার জোর দেওয়া কৌশলগত পরিবেশকে আরও খারাপ করবে এবং অনেককে তাদের কৌশলগত আক্রমণাত্মক অস্ত্র বাড়াতে উৎসাহিত করবে, যাতে গোল্ডেন ডোমকে হারানো যায় অথবা সহজভাবে নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা যায়। গোল্ডেন ডোম কখনোই কৌশলগত স্থিতিশীলতা দেওয়ার লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। এই ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো নিয়ে আমি ভবিষ্যতের একটি প্রবন্ধে আলোচনা করব।
ট্রাম্প প্রশাসন গত কয়েক মাসে অনেক ভুল করেছে। চীনের সাথে বিবাদে জড়ানো তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভুল। ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা দলটি চীন-বিরোধীদের দ্বারা প্রভাবিত, যারা চীনের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা ও প্রভাব সহ্য করতে পারে না। কিন্তু চীন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিরল খনিজ এবং চুম্বকের বৈশ্বিক সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। আমেরিকার সেমিকন্ডাক্টর তৈরির সফটওয়্যার, ইথেন ও বিউটেনের মতো গ্যাস এবং পারমাণবিক ও মহাকাশ ব্যবস্থার যন্ত্রাংশ রপ্তানি সীমিত। ট্রাম্পের এই চ্যালেঞ্জের জবাবে চীনারা আমেরিকার যুদ্ধবিমান, বিমানবাহী রণতরী ও কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় বিরল খনিজগুলির ওপর তাদের রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। চুম্বকের অভাবে ফোর্ড মোটরসকে ইতিমধ্যেই চীনে একটি কারখানা বন্ধ করতে হয়েছে।
ব্যালিস্টিক, হাইপারসনিক ও ক্রুজ মিসাইল বা ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করার জন্য ট্রাম্পের ১৭৫ বিলিয়ন (সাড়ে ১৭ হাজার কোটি) ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র-বিরোধী ঢাল তৈরির পরিকল্পনা ড্রোন প্রযুক্তি থেকে আমেরিকাকে রক্ষা করতে পারবে না, যা ইতিমধ্যেই ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধে প্রমাণিত। পেন্টাগন চালক-নিয়ন্ত্রিত যুদ্ধবিমানের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীল এবং রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ে এত কার্যকরভাবে ব্যবহৃত ছোট ড্রোনে বিনিয়োগ করেনি। আমেরিকার বিরোধীরা জাতীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার বিষয়ে আমেরিকাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করবে না। তারা কম ব্যয়বহুল অথচ আক্রমণাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে বিনিয়োগই যথেষ্ট মনে করবে। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ায় আমেরিকা এই সমস্ত দিক থেকে পরাজিত হবে।
ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধের প্রতিটি ক্ষেত্রে চীনের প্রভাব রয়েছে। উপরন্তু, শুল্কের কারণে ব্যবসা ও ভোক্তাদের জন্য দেশে পণ্য মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পায়। ট্রাম্পের জেনোফোবিয়া (বিদেশিদের প্রতি বিদ্বেষ) এবং আমেরিকার অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে তার প্রচারণা আমাদের সেরা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের নিজ দেশে ফিরে যেতে উৎসাহিত করবে। আমরা আমাদের ‘সেরা এবং উজ্জ্বলতম’ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের হারানোর ফলে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে ক্ষতিগ্রস্ত হব। ১৯৮০ ও ১৯৯০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে এমনটি ঘটেছিল এবং ২০২২ সালে মস্কোর ইউক্রেন আক্রমণের পর রাশিয়ার ক্ষেত্রেও এটি ঘটেছিল।
ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ শুধু আমেরিকার বৈশ্বিক প্রভাবের পতনকেই নির্দেশ করে না, এটি আমেরিকান ডলারের মূল্য ও প্রভাবকেও দুর্বল করবে। ইতিমধ্যেই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে যে, আমেরিকার শুল্ক দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সাথে আমাদের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং আমেরিকার ক্ষতির ফলে চীন লাভবান হচ্ছে। গ্লোবাল সাউথেও একই অবস্থা। এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে যে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা আমেরিকার ট্রেজারি বন্ড এড়িয়ে আমেরিকান ডলারের বিকল্প খুঁজছে।
ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ প্রচার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। ১৯৪০ সালে ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের বিরুদ্ধে চার্লস লিন্ডবার্গের বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচার একই ধরনের ছিল। যেখানে ট্রাম্প ইসরায়েলের ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যা জন্য চালিত সামরিক অভিযানকে উপেক্ষা করছেন, সেখানে ইউরোপীয় ও অন্যান্য দেশগুলো বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জোরদার করছে।
অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে ও যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইসরায়েলি মন্ত্রিসভার দুটি কট্টর-ডানপন্থী মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির এবং বেজালেল স্মোট্রিচের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা এবং ‘অন্যান্য পদক্ষেপ’ নেওয়ার ঘোষণা করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ‘সহিংসতা উসকে দেওয়ার’ অভিযোগে আরোপ করা হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট থমাস ফ্রিডম্যান সতর্ক করেছেন যে তাদের ‘কদর্য, ফিলিস্তিন-শূন্য গাজা নীতি’ ইহুদিদের সর্বত্র বিপদে ফেলবে।
আমেরিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা থেকে পূর্ণ অংশগ্রহণ প্রত্যাহার করে নেওয়ায় চীন লাভবান হচ্ছে। অথচ এই সংস্থাগুলো তৈরি করতে আমেরিকার অবদানই ছিল সবচেয়ে বেশি। আমেরিকার ভূমিকা কমে যাওয়ায় যে কোনো ক্ষতির জন্য চীন তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকা বৈশ্বিক নেতা হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু বৈশ্বিক আধিপত্য অর্জনে অতিরিক্ত সম্পদ ও শক্তি ব্যয় করেছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থার এই হতাশাজনক অবস্থার সমাধান করা যাচ্ছে না, কারণ রিপাবলিকান-নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ট্রাম্প প্রশাসনের স্বৈরাচারকে চ্যালেঞ্জ করবে না। একজন অভিজ্ঞ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের অনুপস্থিতি আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় কূটনীতির অনুপস্থিতি নিশ্চিত করেছে।
ভিডিও দেখুন:
রাশিয়া ও চীনকে বিভক্ত করার আমাদের প্রচেষ্টা মস্কো ও বেইজিংকে আরও কাছাকাছি এনে দিয়েছে। কিন্তু রাশিয়া বা চীন কেউই সেই হুমকি বা চ্যালেঞ্জের প্রতিনিধিত্ব করে না, যা একসময় নাৎসি জার্মানি বা সোভিয়েত ইউনিয়ন করত। এখন নির্বোধ দ্বৈত-প্রতিরোধ নীতি অনুসরণ না করে কূটনীতির মাধ্যমে মস্কো এবং বেইজিং উভয়ের সাথে আলোচনা শুরু করার একটি পথ খুঁজে বের করার সময়। তা না করার কারণে কেবল উত্তেজনা বাড়ছে। প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং শি জিনপিং উভয়ই দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু করার আগ্রহের ইঙ্গিত দিয়েছেন। আমাদের কাছে এটি করার জন্য কোনো পরিকল্পনা বা প্রক্রিয়া নেই এবং একটি গুরুতর জাতীয় নিরাপত্তা টিমের অনুপস্থিতি সুযোগ হারানোর বিষয়টিকে নিশ্চিত করে।আমেরিকার সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব সম্পদের অপচয় করেছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে কিছুই অর্জন করতে পারেনি। এটি শুধুমাত্র প্রেসিডেন্টের স্বার্থ পূরণ করে এমন ন্যাশনাল গার্ড এবং মেরিন সেনা মোতায়েন করার কারণে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির হুমকি দেখা দিচ্ছে। সাংবিধানিক গণতন্ত্রের প্রতি ট্রাম্পের অবজ্ঞা একটি অস্তিত্বগত হুমকি সৃষ্টি করে। এর বিরুদ্ধে বড় ধরনের রাজনৈতিক বিরোধিতা প্রয়োজন, যার অভাব রয়েছে।
মেলভিন এ. গুডম্যান: সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির একজন সিনিয়র ফেলো এবং জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি সিআইএ-রও একজন প্রাক্তন বিশ্লেষক।
(লেখাটি কাউন্টারপাঞ্চ ডট অর্গ থেকে নেওয়া এবং ইংরেজি থেকে ঈষৎ সংক্ষিপ্তকারে অনূদিত।)