প্রত্যাবর্তন কতটা মহানাটকীয় হতে পারে, কতটা রোমাঞ্চকর হতে পারে, গতকাল ইউরোপা লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের দ্বিতীয় লেগে সেটারই সাক্ষী হয়েছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মাঠ ওল্ড ট্রাফোর্ড। শেষ মিনিট বিশেকে ৫ গোল, অতিরিক্ত সময়ের ৬ মিনিট বাকি থাকার সময়েও দুই গোলে পিছিয়ে ম্যান ইউনাইটেড। এমন ম্যাচেই শেষ ছয় মিনিটে তিন গোল করে ম্যাচ জিতে গেল ম্যান ইউনাইটেডই!
এতেও অবিশ্বাস্য লাগছে না? আচ্ছা, তাহলে ইতিহাসের একটা অংশ শুনে নিন - শেষে যে তিন গোল করল ইউনাইটেড, তার শেষ দুটি একেবারে ১২০তম মিনিটে! ইউরোপা লিগ তো ইউরোপা লিগ, চ্যাম্পিয়নস লিগসহ ইউরোপিয়ান কোনো টুর্নামেন্টেই কোনো দলের ১২০তম মিনিটে গিয়ে দুই গোল করার রেকর্ড নেই!
স্কোরলাইনই অবিশ্বাস্য! ম্যান ইউনাইটেড ৫-৪ লিওঁ! সেখানেও এক কীর্তিতে রেকর্ডবইয়ে টানাটানি - ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে লিগে আর্সেনালের বিপক্ষে ম্যাচের বাইরে ইউনাইটেডের ইতিহাসেই ৫-৪ ব্যবধানে জয়ের ম্যাচ বলতে গতকালের ম্যাচটি।
দুই লেগ মিলিয়ে ৭-৬ ব্যবধানে জিতে সেমিফাইনালে ইউনাইটেড। লিগে ১৪তম দলটা এখন ইউরোপা লিগের শিরোপার - এবং সেটি জিতে আগামী মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগেও খেলার - স্বপ্নের তিন ম্যাচ দূরত্বে! কিন্তু সে পথে যেতে রুবেন আমোরিমের দলটা কাল যেভাবে ২-০ গোলে এগিয়ে যাওয়া, সেখান থেকে ২-২ হয়ে দশজনের হয়ে পড়া লিওঁর বিপক্ষেই অতিরিক্ত সময়ে ২-৪ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়া, বাদ পড়ার মুখেই চলে যাওয়া, সেখান থেকে শেষ ছয় মিনিটের গায়ে কাঁটা দেওয়া রোমাঞ্চ জাগিয়ে ফিরে এসেছে...একে শব্দে বাঁধা কঠিন!
লিওঁর বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগের ম্যাচটা শেষ হয়েছিল ২-২ সমতায়। সেদিন ইউনাইটেড অবশ্য দুটো গোলই হজম করেছিল গোলকিপার আন্দ্রে ওনানার দৃষ্টিকটু দুটি ভুলে। সে দুঃখ ভুলে গতকাল ম্যাচের প্রথমার্ধে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে সেমিফাইনালের পথ অনেকটা কমিয়ে ফেলে রুবেন আমোরিমের দল। প্রথমার্ধে ইউনাইটেড যেমন খেলেছে, এক কথায় আমোরিমের অধীনে তাদের সেরা পারফরম্যান্সই বলা যায়!
নাটকীয়তার শুরুটা দ্বিতীয়ার্ধে। ম্যাচের ৭১ আর ৭৫ মিনিটে দুই গোল শোধ দিয়ে ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে নিয়ে যায় লিওঁ। তবে নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট বাকি থাকতে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন দলটির মিডফিল্ডার কোরেন্তা তোলিসো। একজন কম নিয়েও অতিরিক্ত সময়ের প্রথম ২০ মিনিটের মধ্যে আরও ২ গোল করে বসে ফরাসি ক্লাবটি। ম্যাচের বাকি তখন মোটে ১০ মিনিট। ৪-২ ব্যবধানে পিছিয়ে থাকা ইউনাইটেড বিদায়ের ক্ষণ গুণছে।
কিন্তু এরপর ওল্ডট্রাফোর্ডে উপস্থিত ৭৩ হাজার বেশি দর্শক যেটার সাক্ষী হয়েছে, সেটা রূপকথার গল্পকেও হার মানাবে। ১১৪ মিনিটে ব্রুনো ফের্নান্দেসের পেনাল্টিতে ব্যবধান কমায় ইউনাইটেড। নির্ধারিত সময়ের শেষ মিনিটে স্কোরলাইন ৪-৪ করেন কোবি মাইনু। সে রোমাঞ্চের ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই যোগ করা সময়ের প্রথম মিনিটে গোল করে দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তনের মহাকাব্যের শেষ টানেন হ্যারি ম্যাগুয়ের।
গতকাল ম্যাচটা কতটা জমজমাট হয়েছে, সেটা পরিসংখ্যানেও স্পষ্ট। বল দখলে লিওঁ কিছুটা এগিয়ে থাকলেও আক্রমণে দুদল ছিল সমানে সমান। দুদলই শট নিয়েছে সমান ২১টি করে। এর মধ্যে ইউনাইটেডের ৮টি শট ছিল লক্ষ্যে, আর লিওঁ গোলমুখে রাখতে পেরেছে ৯টি শট।
আক্রমণ প্রতি আক্রমণের ম্যাচে ইউনাইটেড প্রথম গোলের দেখা পায় ১০ মিনিটেই। আলেহান্দ্রো গারনাচোর পাসে আমোরিমের দলকে এগিয়ে দেন মানুয়েল উগার্তে। আর প্রথমার্ধের যোগ করা সময়ে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন দিয়োগো দালোত।
অবশ্য গোলের বেশ কয়েকটি পরিষ্কার সুযোগ পেয়েছিলও ফরাসি ক্লাবটিও। কিন্তু আগের ম্যাচে ভুল করা ওনানা যেন গতকাল প্রথমার্ধে চীনের প্রাচীর তুলে দাঁড়িয়েছিলেন পোস্টের নিচে। তবে দ্বিতীয়ার্ধে আর প্রাচীর অক্ষত রাখতে পারেননি। ৭১ মিনিটে তোলিসোর হেডে ব্যবধান কমায় (২-১) লিওঁ। আর ৪ মিনিট পর ম্যাচে সমতা টানেন তাগলিয়াফিকো।
এরপর তোলিসোর ওই লাল কার্ড। ৮৯ মিনিটে লেনি ইয়োরোকে ফাউল করে দ্বিতীয়বার হলুদ কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন ফরাসি মিডফিল্ডার।
একজন কম নিয়েও অতিরিক্ত সময়ের শুরুতে কী দাপট লিওঁর! ১০৪ মিনিটে রায়ান শের্কির গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর ১১০ মিনিটে পেনাল্টি থেকে ব্যবধান আরও বাড়ান (২-৪) লাকাজেত। লিওঁর সেমিফাইনালের স্বপ্ন তখন রঙিন। ওল্ড ট্রাফোর্ডের অনেক দর্শক মাঠ ছাড়ছেন তখন। কিন্তু ইউনাইটেড যে ১৯৯৯ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের মতো কিছু করে বসবে, তা কে ভাবতে পেরেছিল!
ম্যাচ শেষে ইউনাইটেড কোচ রুবেন আমোরিম বলেছেন, ‘একজন বেশি খেলোয়াড় নিয়েও ৪-২ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ার পর অনেকেই ভেবেছিল আশা শেষ। কিন্তু তখনো সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। আমার তখনো মনে হচ্ছিল, এখানে যেকোনো কিছুই সম্ভব।’
আর এই অসাধ্য সাধনের পেছনে দর্শকদের অনুপ্রেরণার জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন আমোরিম, ‘স্টেডিয়ামে (দর্শকদের) গর্জন ছিল এ যাবৎকালের সেরা। কেউ হয়তো জার্সি, প্ল্যাকার্ড নিয়ে এসেছ। কিন্তু আমি গর্জনটাই মনে রাখতে চাই। এটা পৃথিবীর সেরা গর্জন! আমার সেই দর্শকদের জন্য মায়া হচ্ছে, যাঁরা ৪-২ এর পর বের হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা আফসোসে পোড়ার কথা।’
চলতি মৌসুমে ইউনাইটেডের একের পর এক বাজে পারফরম্যান্স নিয়ে সমালোচনা কম হয়নি। গতকাল রোমাঞ্চে ঠাসা ম্যাচ জিতেও সে প্রসঙ্গে কথা বলেছেন আমোরিম। ইউনাইটেড কোচ বলেছেন, ‘আমরা জানি (চলতি মৌসুমে) আমরা কতটা খারাপ খেলেছি। আর এ জন্য সমালোচনাও আমাদের প্রাপ্য। কিন্তু মৌসুমটাকে স্পেশাল করার জন্য এখনো আমাদের হাতে সময় আছে।’