স্বাভাবিক কোনো দিনে ইউভেন্তুসের খেলোয়াড়দের তখন ম্যাচের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকার কথা ছিল। ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপে গতকাল ইতালিয়ান ক্লাবটি খেলেছে আবুধাবির আল-আইনের বিপক্ষে, ৫-০ গোলে জিতেছেও। তবে শক্তিতে মেরুব্যবধান থাকা দুই দলের ম্যাচ নয়, ক্লাব বিশ্বকাপে গতকাল ওয়াশিংটনের ম্যাচটি বেশি আলোচনায় ম্যাচের আগের ঘটনা নিয়ে।
রাতে ম্যাচ, তার আগে বিকেল বেলা ইউভেন্তুসের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের কয়েকজনকে দেখা গেল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সংবাদ সম্মেলনে, ট্রাম্পের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরা। আর ট্রাম্প তাঁদের পেছনে দাঁড় করিয়ে রেখে সংবাদ সম্মেলন করলেন কী নিয়ে? ইসরায়েল-ইরানের চলমান সংঘাত আর ইরানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত নিয়ে!
১৬ মিনিটের সেই সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পের পেছনে দাঁড়ানো ইউভেন্তুস খেলোয়াড়দের মধ্যে দুজন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রেরই – ওয়েস্টন ম্যাককেনি ও টিমোথি উইয়াহ। অভিজ্ঞতাটা ম্যাচের পর এক সংবাদমাধ্যমে ম্যাককেনি জানিয়েছেন এভাবে, ‘সত্যি বলতে, আমার জন্য বিস্ময়কর ছিল ব্যাপারটা। আমাদের বলা হয়েছিল যে আমাদের ওখানে (হোয়াইট হাউজ) যেতে হবে, যাওয়া ছাড়া তাই কোনো উপায় ছিল না। ওখানে সত্যিই অবাক হয়েছিলাম। অদ্ভুত একটা ব্যাপার। তিনি (ট্রাম্প) যখন ইরানকে জড়িয়ে রাজনীতি আর ওসব ব্যাপার নিয়ে বলা শুরু করলেন, আমার জন্য ব্যাপারটা ছিল এমন যে… আমি তো শুধু ফুটবলই খেলতে চাই, ভাই!’
কে কে ছিলেন ইউভেন্তুসের পক্ষ থেকে, সেটা জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম দ্য অ্যাথলেটিক – ম্যাককেনি আর উইয়াহর বাইরে খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন দুসান ভ্লাহোভিচ, মানুয়েল লোকাতেল্লি, তেইউন কুপমেইনার্স, ফেদেরিকো গাত্তি; ছিলেন ইউভেন্তুস কোচ ইগর তুদর। ইউভেন্তুসের মালিকপক্ষ আনিয়েল্লি পরিবারের প্রধান মুখ জন এলকানও ছিলেন। এর বাইরে ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো আর যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেশনের সাবেক প্রধান ও ২০২৬ বিশ্বকাপের লজিস্টিকস, কার্যক্রম ও নিরাপত্তার নিমিত্তে সাম্প্রতিক সময়ে গঠিত ‘হোয়াইট হাউজ টাস্ক ফোর্সে’র জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা কার্লোস করদেইরো।
ট্রাম্পকে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের একটা জার্সি উপহার দিয়েছেন ইনফান্তিনো, জার্সির গায়ে নাম্বার লেখা ছিল ৪৭ – ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট কিনা! ইউভেন্তুস তাদের একটি জার্সি উপহার দিয়েছে ট্রাম্পকে।
সংবাদ সম্মেলনে কী কী বলেছেন ট্রাম্প? সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই ওয়াশিংটনের ম্যাচটির টিকিটের সবই বিক্রি হয়েছে বলে দাবি করেন ট্রাম্প, যে ব্যাপারে পেছন থেকে সম্মতি জানান ইনফান্তিনোও। তবে দ্য অ্যাথলেটিক জানাচ্ছে, ওই সংবাদ সম্মেলনের সময়েও টিকিট ‘অ্যাভেইলেবল’ দেখানো হচ্ছিল ওয়েবসাইটে, শেষ পর্যন্ত স্টেডিয়ামের ২০ হাজার ধারণক্ষমতার মধ্যে পূরণ হয়েছে ১৮১৬১।
এরপর ম্যাককেনি-উইয়াহকে নিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘এখানে যুক্তরাষ্ট্রের দুজন অসাধারণ খেলোয়াড় আছেন। আমার আমেরিকান খেলোয়াড়েরা, তোমরা কোথায়?’ তাঁরা দুজন মাথা নাড়ালে ট্রাম্প বলেন, ‘দারুণ! তো..শুভকামনা। আশা করি মাঠে তোমরাই সেরা দুই খেলোয়াড় হবে।’
মজার ব্যাপার, দুজনের মধ্যে ম্যাককেনি ২০২০ সালে ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সময়ে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের ক্ষণে ট্রাম্পের কড়া সমালোচনা করেছিলেন। জার্মান সংবাদমাধ্যম বিল্ডে সমালোচনার এক পর্যায়ে ম্যাককেনি বলেছিলেন, ‘…আমার চোখে, তাঁকে বর্ণবাদীও বলা যায়!’
আর টিমোথি উইয়াহর বাবা – ফুটবল কিংবদন্তি ও ২০১৮ সাল থেকে ছয় বছর লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট – জর্জ উইয়াহ এবার ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্পকে ভূয়সী প্রশংসায় ভাসিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার, এই সপ্তাহে নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, ৩৬টি দেশের ওপর ‘ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা’ দিতে যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন, ওই ৩৬ দেশের একটি লাইবেরিয়া!
সংবাদ সম্মেলনে এক পর্যায়ে ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে কথা বলতে বলতে ট্রাম্প হঠাৎ পেছনে ইউভেন্তুসের খেলোয়াড়দের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘…ভাইয়েরা, তোমাদের দলে কি মেয়েরা খেলতে পারবে?’ হঠাৎ এমন প্রশ্নে ইউভেন্তুসের খেলোয়াড়েরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকলে ট্রাম্প আবার উল্টো পাশে ইউভেন্তুসের কর্তাদের দিকে ঘুরে প্রশ্নটা করেন। ইউভেন্তুস কর্তারা তখন তাঁকে বলেন যে, তাঁদের ক্লাবে দারুণ একটি মেয়েদের দল আছে। ট্রাম্প তখন ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু নিয়ে ব্যঙ্গ বোঝাতেই বলেন, ‘কিন্তু ওদের (ছেলেদের) তো মেয়েদের সঙ্গে খেলা উচিত!’ এর উত্তরে ইউভেন্তুস কর্তারা কিছু না বলায় ট্রাম্প এরপর বলেন, ‘ওরা বেশ কূটনৈতিক জবাব দিচ্ছে!’
এরপর আলোচনা গড়ায় মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত নিয়ে। এত সংঘাত আর মৃত্যু দেখতে তাঁর ভালো লাগছে না বলে জানান। এরপর সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন ক্লাব বিশ্বকাপ নিয়ে প্রশ্ন করতে। কিন্তু অদ্ভুত ওই ১৬ মিনিটের সংবাদ সম্মেলনের বিস্ময় আরও বাড়ানো তথ্যটি জানিয়ে দ্য অ্যাথলেটিক লিখেছে, ওখানে উপস্থিত সাংবাদিকরা ছিলেন রাজনীতিবিষয়ক বিটের, তাঁদের ক্লাব বিশ্বকাপ নিয়ে প্রশ্নে আগ্রহ ছিল না। ট্রাম্পের আহ্বানের পর প্রথম প্রশ্নটা হলো এ নিয়ে যে, ইরানের হামলার আশঙ্কায় ইসরায়েল যে কিছু অঞ্চলের জনগণকে বাড়িঘর খালি করে নিরাপদে সরে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে, সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট সর্বশেষ কিছু জানেন কি না!
এরপর ইরানে সরকার বদলের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্নে ট্রাম্প বলেন, তাঁর সবকিছু নিয়েই পরিকল্পনা সাজানো আছে। ইরান সময় থাকতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে না গিয়ে ভুল করেছে বলেও জানান। পরের প্রশ্ন, ‘ইরানের বর্তমান সরকারের কি পতন হতে পারে?’ ট্রাম্পের উত্তর, ‘যেকোনো কিছুই হতে পারে।’ পুরো সময়ে পেছনে ইউভেন্তুসের খেলোয়াড়-কোচদের হতবিহ্ববল চেহারা চোখে পড়ল।
ইউভেন্তুসের খেলোয়াড়েরা কেন হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে গেলেন? দ্য অ্যাথলেটিক জানিয়েছে, ফিফা আর হোয়াইট এ ব্যাপারে পরে ব্যাখ্যা দিয়েছে। ইউভেন্তুসের কয়েকজন প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকেই তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
ট্রাম্পের সঙ্গে ইতালিয়ান ক্লাবটির মালিকপক্ষের সাক্ষাৎ সাম্প্রতিক সময়ে আরও একবার হয়েছে বলে জানিয়েছে দ্য অ্যাথলেটিক। এখানে ইউভেন্তুসের মালিকপক্ষের প্রধান ব্যক্তি জন এলকানের পরিচয়টা প্রাসঙ্গিক। নিউইয়র্কভিত্তিক ব্যবসায়ী এলকান ইউভেন্তুসের সিংহভাগ শেয়ারের মালিক এক্সর গ্রুপের প্রধান নির্বাহী। এক্সর আবার ইউভেন্তুসের মালিকপক্ষ আনিয়েল্লি পরিবার দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। ইতালিয়ান বিখ্যাত কার কোম্পানি ফিয়াতের প্রধান শেয়ারহোল্ডার বিখ্যাত ব্যবসায়ী – যিনি মারা গেছেন ২০০৩ সালে – জিয়ান্নি আনিয়েল্লির নাতি এলকান। স্তেল্লান্তিস গ্রুপেরও প্রধান এলকান। এই স্তেলান্তিস গ্রুপ হলো বিশাল এক শিল্পগোষ্ঠী, যার অধীনে আলফা রোমেও, ক্রিসলার, ফিয়াত, জিপ, মাসেরাত্তি, পুজোঁ, ভক্সহলের মতো কোম্পানি আছে।
আনিয়েল্লি পরিবার সব সময়ই আটলান্টিকের দুই পাড়ের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়নে আগ্রহী। জিয়ান্নি আনিয়েল্লি যেমন, জীবিত থাকার সময়ে সে সময়ের ইউএস সেক্রেটারি অব স্টেইট হেনরি কিসিঞ্জারকে ইউভেন্তুসের অনেক ম্যাচে স্টেডিয়ামে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিসিঞ্জার-জিয়ান্নির সম্পর্কও ছিল ভালো বন্ধুর মতো।
সাম্প্রতিক সময়ে এলকান গাড়ি তৈরির শিল্পে যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। বুধবার সাক্ষাতের পর ট্রাম্প তাঁর ব্যাপারে বলেছেন, এলকান ‘দারুণ এক ব্যবসায়ী, অটোমোবাইল শিল্পে যিনি দারুণ কাজ করছেন, যিনি জাত বিজয়ীদের উত্তরসূরি।’
দ্য অ্যাথলেটিক জানাচ্ছে, হোয়াইট হাউজে যাওয়ার আগে ইউভেন্তুসের খেলোয়াড়-কোচেরা জানতেন না যে তাঁদের এভাবে সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের দুই খেলোয়াড় ম্যাককেনি আর উইয়াহ যে সেখানে থাকবেন, সেটা আবার জানতেন না যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেশনের সিনিয়র কর্মকর্তারা।
সংবাদ সম্মেলনে থাকা নিয়ে উইয়াহ ম্যাচের পর বলেছেন, ‘হোয়াইট হাউজে যেতে পারার অভিজ্ঞতা তো ভালোই, প্রথমবার গেলাম। অবশ্যই দারুণ। তবে আমি তো রাজনীতির মানুষ না, সেটা তাই খুব একটা ভালো লাগেনি।’
সংবাদ সম্মেলনে ইউভেন্তুস কোচ তুদর এ নিয়ে অভিজ্ঞতায় বললেন, ‘ভালোই তো, হোয়াইট হাউজে তো আর প্রতিদিন যাওয়ার সুযোগ হয় না।’ অ্যাথলেটিক লিখেছে, তাদের প্রতিনিধি এরপর যখন তুদরকে বিস্তারিত জানাতে বলেন, একজন ফুটবল কোচ হিসেবে ওভাল অফিসে ইরান-ইসরায়েল ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের আলোচনার সময়ে থাকার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলতে বলেন, সেখানে উপস্থিত ফিফার মডারেটর বাধ সাধেন। তিনি বলেন, প্রশ্নগুলো শুধু ক্লাব বিশ্বকাপের ম্যাচ নিয়েই করতে হবে। দ্য অ্যাথলেটিক পাল্টা যুক্তিতে যখন বলে যে ম্যাচের দিনে কোচ-খেলোয়াড়েরা যেখানে ছিলেন, সে নিয়ে প্রশ্ন এখানে অপ্রাসঙ্গিক নয়, ফিফার মডারেটর আবার একই কথা বলে তাদের থামিয়ে দেন।
ওদিকে ইনফান্তিনো ফিফার সভাপতি হয়েও কেন ট্রাম্পের সংবাদ সম্মেলনে গেলেন, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ফিফার দিক থেকে অবশ্য নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে ব্যাখ্যায় বলেছেন, ফিফা এই ইভেন্টের পরিকল্পনায় ছিল না। তবে ট্রাম্পের সংবাদ সম্মেলনে যখন যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার প্রভাব ক্লাব বিশ্বকাপে যেতে চাওয়া দর্শকদের ওপর পড়বে কি না বলে প্রশ্ন হয়, ট্রাম্প ইনফান্তিনোর দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘জিয়ান্নি, আপনিই বলুন।’ ফিফা সভাপতি তখন বলেন, ‘না, না, এটা আমাদের ভাবার বিষয় নয়।’ এরপর ক্লাব বিশ্বকাপে কীভাবে সবকিছু মসৃণভাবে এগোচ্ছে, সে ব্যাখ্যা দিয়ে উত্তর সারেন তিনি।
অদ্ভুত সংবাদ সম্মেলন, ট্রাম্পের পেছনে উপস্থিতি নিয়ে যেখানে প্রশ্ন আছে, সেখানে প্রশ্ন আর উত্তরগুলোও অদ্ভুতই হলো।